এমন ইয়াতিম যার বাবা-মা এখনো জীবিত। শায়েখ ডঃ আবদুস সালাম আজাদী

আধুনিক আরবি ভাষার কবিগুরু আহমাদ শাওক্বীর একটা কবিতার অংশ পড়ে থমকে গেলাম। তিনি বলেছেনঃ 

ليس اليتيمُ من انتهى أبوَاهُ من ***** هَمِّ الحياةِ وَخَلَّفاهُ ذليلا
فأصابَ بالدنيا الحَكيمةِ منهما ***** وبحُسْنِ تربيةِ الزمان بَديلا
إن اليتيمَ هو الذي تَلْقَى له ***** أماً تخلَتْ أو أباً مَشْغولا 

অর্থাৎ, “ইয়াতিম সে নয় যার বাবা মা দু’জনেই দুনিয়ার দুঃখ শেষ করে তাকে খুব হীন অবস্থায় রেখে গেছে। পরে সে তাদের থেকে পাওয়া দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করেছে, এবং যুগের সুন্দর শিক্ষা পেয়ে সেই শোকের প্রতিদান লাভ করেছে। 
বরং ইয়াতিম হলো সেই, এমন মা সে পেয়েছে, যিনি তাকে পরিত্যাগ করেছেন, আর পেয়েছে এমন বাবা যিনি ব্যস্ত আর ব্যস্ত”। 

কবিদের কিছু কিছু কথা পড়লে মনে হয় আসমানি কথার আঁকর, যা কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যকে খুব সুন্দর করে মনে গেঁথে যাবার মত করে বলতে পারে। শাওক্বীর এই কথা গুলো পড়ে শরীর আমার কেঁপে উঠলো। সোয়ান্সীর বাসা থেকে বিশাল ময়দানে চোখ দু’টা উদাস ভাবে ছড়িয়ে দিতেই দেখলাম আসলে আজকের এই দুনিয়া ঐ সব ইয়াতিম দিয়ে ভরা। 

বাবা মা দুইজনই ব্যস্ত। মা ব্যস্ত রান্না, বাড়া, টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে। তিনি ব্যস্ত আপন ভুবনে কর্তৃত্ব সৃষ্টি নিয়ে। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নানা চর্চা নিয়ে, বা সেই সৌন্দর্য ধরে রাখার নানা রকম কর্ম কান্ড দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত করে। মা ব্যস্ত বান্ধবীদের সাথে সহাস্যে সময় কাটানোয়, কিংবা মোবাইল কোম্পানীগুলো থেকে পাওয়া ফ্রী টাইম বা এমবির সৎকার করতে। মা ব্যস্ত তার মাথায় ফেনায়িত পরিকল্পনার সম্ভার সাজাতে, অথবা আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের ভাঁজ ফেলাতে। 

মা আজ বিধাতার দেয়া দায়িত্বের বাইরে নেয়া বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিরক্ত ও অসুস্থ। অফিসে তাকে হারাতে হয় রাণীর মর্যাদা, কিংবা ভালোবাসার প্রাণোচ্ছাস। সেখা্নে তার পরিণতি হলো কর্মচারীর লকব ও দাসীত্বের পরিহাস। হয়ত “বসেরা” একটু ভালো হলে লাভ করে হেরেমীয় চোখের বাণ, কিংবা গায় পড়া প্রেম প্রেম বা আদর আদর শব্দের বিন্যাসে গাঁথা গোঁফ কেলানো হাসির ভাষা। মা আজ ব্যস্ত ঐ ভূবনের কাজগুলোয় ১০০% পারফেকশানের ট্রায়াল করে। 

আজ তার মা ভীষণ ব্যস্ত। দীনের কাজ করতে করতে সারা দিন মান বাইরে সময় দিতে হয়। সপ্তাহে ৩দিন বৈঠক। বাকী কয়দিনে রিপোর্ট রাখতে রুটিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এক বোনের আলিফ লাম মিমের টান গুলো শুদ্ধ করতে তার মা আজ হাসি মুখে সারাদিন ব্যস্ত, কিন্তু তার “আলাম তারা কায়ফা ফা’আলার” খবর মায়ের নেয়ার সময় নেই। যদি কখনো সময় হয়েছে ছেলের তেলাওয়াত শোনার, ভুল হলে মায়ের হাতের কিল ঘুষির ওযন মাপতে হয়েছে তাকে। আজ তার মাকে দেখতে পায় ইসলামের জন্য বাইরের পাপীনীদের সোজা পথে রাখতে নাকের ঘাম ও চোখের পানি এক করছেন, কিন্ত তার সামান্য ভুলে দমাদম মস্ত কালান্দর। মায়ের রাগ দেখে চোখের তারায়, রাগের ভাষায়, এবং বুকের উঠা নামায়।

আজ তার মা ভীষণ ভাবে তাকে একা করে রেখেছে। ছোট থাকতে গ্রাম্য অশিক্ষিত এক কাজের মেয়ের কোল হতো তার আরামের দোলনা। তার মুখের ভাষাই হয়েছে মাতৃভাষার বিকল্প। তার হাত থেকে খাওয়া “দানো” দুধ, বা “কাও এন্ড গেইট” দুধ হতো মায়ের বুকে আসা আসমানী দুধের বিকল্প। তার অপরিশিলীত, কিংবা নোংরা শব্দ হয়েছে তার ব্রেইনে যুক্ত হওয়ার শব্দের ভান্ডার। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলেও, পুলিশের সেরা অফিসার হলেও, সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেন মূল সচিব হয়েও সেই সব শব্দের বোমা ফাটিয়ে জানান দেয় কত বড় “শব্দ ইয়াতিম” সে। 

তার মা তাকে আল্লাহর ৯৯ নাম দূরে থাক একটা নাম ও ভালো করে শিখাননি। শিখেছে কাজের মেয়ের কাছে শাহরুখের নাম। তার মায়ের কাছ থেকে দীনের কি শিখেছে? হাতড়িয়েও পায়না খুঁজে সে। মায়ের জগত সে দেখেনা, মায়ের জীবন থেকে সে শেখেনা, মায়ের আঁচলে তার দেহ লুকানোর ফুরসাত পায়না। আজ ১৯ বছরে সে যখন মা বাবা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসে, বা দেশ পাড়ি দেয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে তার মা আর বর্ণিল হয়ে ধরা দেয়না। মা তার থাকা আর না থাকা?! আক্ষরিক অর্থেই যেন সে মা হারা ইয়াতিম। 

আমি উন্মুক্ত মাঠের মাঝে সীগলের ডাক শুনছি। আর খুঁজতেছি তাদের সেই দঙ্গলে ‘পোলাপাইন’ ও বাবা-মার কিছু দৃশ্য আছে কিনা। তিনটা কোণায় দেখি কিছু পাখি হা করে আছে, আর মা তার দুই ঠোঁট গলার ভেতরে দিয়ে নিজের খাবার গুলো উগরে দিচ্ছে। দেখলাম কিছু সীগাল চিৎকার করে আপন সন্তান কে দু’পাখা মেলে উড়াতে শেখাচ্ছে। সাগর পাড়ে বাসা হওয়ায় লাভ হলো আমার। শাদা শাদা পাখিরা আজ আব্দুস সালামের শিক্ষক যেন। ছোট অসহায় বাচ্চাকে উড়াতে শেখানো বাবার যে কষ্ট, হায়রে মানুষ, তুমি আজ সে দৃশ্য দেখবে কি করে?! 

বাবা তোমার সেই সকালে কাজে যান। তুমি তখন আলাদা করা তোমার ছোট খাটটাতে শায়িত। তিনি বের হবার সময় তোমার কোমল পুষ্পিত মুখে চুমা দেবে? সে সময় তার কই বলো?! নিজেই নিজের নাস্তা বানিয়ে খেয়ে বের হয়েছেন। দৌঁড়েছেন অফিসের দিকে, ব্যবসায়ের কারাগারে কিংবা রাজনীতির কারণে মানুষের উপকারে। আর ফিরে আসন যখন, তুমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্নাতুর হয়ে কখনো হাসছো, কখনো কাঁদছো, কখনো ভয়ে কাঁপছো অথবা কিছু একটার হাতছানি দেখে বিমুগ্ধ হয়ে মুখ হা করে আছো। 

বাবার সময় কই তোমার সাথে গল্প করার? তোমাকে ঘুরাবার? খেলার মাঠে সঙ্গ দেয়ার? তার ফুরসত কই তোমার কিসে আনন্দ তা চোখ ভরে দেখার, কিসে কষ্ট তা মন দিয়ে বোঝার, বা কিসে তোমার শিশুমন পরিতোষিত হয় তা কান দিয়ে শোনার? তোমার বাবা এলাকার ধনী, সর্ব সাধারণ্যে খুবই দামী, তার কাছে সমাজ- রাস্ট্র-সংস্কৃতি সবাই ঋণী। তুমি তার নাম জানো, তার রাগণ্বিত মুখ চেনো, তার ব্যক্তিত্বের অনেক রকম গল্প আছে- তা ও শোন। তুমি তাকে নিয়ে গর্ব করতেও পারো, তার পেছনে থাকা বনী আদমের সারি দেখে মনে মনে তুমি আপ্লুত হতেও পারো, কিংবা তার গল্প ‘প্রচার মিডিয়ায়’ শুনে বা পড়ে সৌভাগ্যের দিকপাল হিসেবে নিজকে ভাবতেও পারো। কিন্তু বাবা তোমার আকাশের চাঁদ, যাকে ছুঁইতে গেলে দূরে চলে যায়। কল্পনার জগতে থাকে আলোর রশ্মী হয়ে দূরাকাশে ডগমগিয়ে অস্তিত্বের জানান দেয়। 

বাবা কি আল্লাহকে জানেন? মহানবীকে (সা) ভালো বাসেন? ইসলামের বুনিয়াদ তার দেহ-মনে আছে? কুরআন কি তিনি সুর করে তিলাওয়াত করেন? কুরআনের আয়াতগুলোর অর্থ কি জানেন? কখনো প্রশ্ন করলে তোমার মা হয়ত ধমক দিয়েছেন তোমাকে। বাবাকে দেখেও বুঝা যায়না মুসলিম কিনা, তার কথা শুনেও জানা যায়না আত্মসমার্পনের আভাস আছে কিনা। চেহারায় ও ফুটে ওঠেনা ঈমানের দীপ্তি কিংবা সাজদার আভা। তাকে দেখে মুহাম্মাদের (সা) প্রতিনিধি মনে না হলেও কখনো সাদ্দামীয় গুম্ফ, অথবা রাজাদের ফ্রেঞ্চ কাটিং দাড়ি, কিংবা নজরুলের মত ‘সাফ সাফা’ মুখের উপরে ঘাড় পর্যন্ত নেতিয়ে পড়া চুলের দঙ্গল। 

এই গুলো হয়ত সময়ে সময়ে তোমার হুজুর স্যার শুনিয়েছেন। তিনি হয়ত বলেছেন তোমাকে বিজ্ঞান শেখাতে, অংক কষাতে, বা ইংরেজি পড়াতে যে খরচ করা হয় তার দশভাগের একভাগ ও ইসলাম শিখতে ব্যয় করা হয়না। হয়তঃ তুমি বুঝেছো দীন হলো একদম সস্তা জিনিষ। দীনের মত অদরকারি হয়ত আর দুনিয়ায় নেই!

একদিন হয়ত তুমি শর্ষে ফুলের কোন দঙ্গলে বসে আনমনা হয়ে তোমার আব্বাকে কাছে পাইতে চাইছো। অমনি হয়ত তোমার দু’চোখে শর্ষে ফুল গুলো নেচে উঠেছে। তুমি হয়ত নিজকে বড় অসহায় ভেবেছো। তোমার বাবা ছিলো, এবং আছেও তোমার চারিপাশে। নেই তবু তোমার চেনা জীবনে। নেই তবু তোমার শিক্ষার ময়দানে। নেই নেই তোমার গড়ে ওঠা একাকিত্বে। তোমার বেড়ে ওঠায় তার হাত নেই, তোমার শেখা জ্ঞানে তার ভাগ নেই, তোমার বুকের দমকা হাওয়ায় তার লকলকে সবুজ পাতা গুলো আজ দোলেনা।

কারণ তুমি বড় ইয়াতিম। হে আদমের সন্তান, হে একবিংশ শতাব্দীর অভিশপ্ত বাবা মার ইয়াতিম সন্তান, বাবা মা ওয়ালা এক আধুনিক ইয়াতিম তুমি!!

এমন ইয়াতিম যার বাবা-মা এখনো জীবিত। শায়েখ ডঃ আবদুস সালাম আজাদী

About The Author
-

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>