রমাদানের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নেবেন যেভাবে।। শায়েখ ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী। অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।

ভূমিকা:
রমাদান ইবাদাতের ভরা মৌসুম। আল্লাহর আনুগত্যের স্বর্ণসময়। স্রষ্টার আনুকূল্যধন্য, অপূর্ব বৈশিষ্ট্যরাজির অনুপম সমাহার। গভীর আকুলতা নিয়ে মুমিন যে মাসের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে প্রতিনিয়ত। অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে যে মহান অতিথির শুভাগমন মূহুর্তটির জন্য। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে অগন্তুক বছরে শুধু একবারই আসে। শুধু দেয়ার জন্য, কিছু নেয়ার জন্য নয়। যার পদধ্বনি আকাশ-বাতাসকে মুখরিত করে মুমিন হৃদয়ে এসে আল্লাহর অপার রহমতের সুরভি ছড়ায়।
যে মাসে নেক আমলের সাওয়াব হয় বহুগুণে বর্ধিত, মুমিনের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে উন্নীত, পুণ্য জোয়ারে অন্তরাত্মা বিধৌত, জান্নাতের দুয়ার অবারিত। যে মাসে রহমতের দরিয়ায় ভেসে যায় রাশি রাশি পাপ, বরকত নেমে আসে এ ধরায়, মুছে যায় জীবনের অভিশাপ। জাহান্নামের দরজা হয় বন্ধ, শৃঙ্খলিত শয়তান, ভাইয়ে-ভাইয়ে কেটে যায় নিত্যদিনের দ্বন্দ্ব। এই মাস তাহাজ্জুদ, তারাবীহ, জিকর, তাসবীহ, তিলাওয়াত, দান-খয়রাত, তাওবাহ ও রহমাতের মাস।
মুমিন জীবনে রমাদান একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক আব্দুর রহমান বিন আবদুল আজীজ আস-সুদাইছ বলেন,
إذا كان الأفراد والأمم محتاجين إلى فترات من الصفاء والراحة؛ لتجديد معالم الإيمان، وإصلاح ما فسد من أحوال، وعلاج ما جدّ من أدواء، فإن شهر رمضان المبارك هو الفترة الروحية التي تجد فيها هذه الأمة فرصة لإصلاح أوضاعها، ومراجعة تاريخها، وإعادة أمجادها، إنه محطة لتعبئة القُوى الروحية والخُلُقية، التي تحتاج إليها كل أمة، بل تتطلع إليها الأفراد والمجتمعات المسلمة،إنه مدرسة لتجديد الإيمان، وتهذيب الأخلاق، وشحذ الأرواح، وإصلاح النفوس، وضبط الغرائز، وكبح الشهوات.

“জাতির জীবনে এমন কিছু মূহুর্ত অতিবাহিত হওয়া জরুরী, যখন আত্মার পরিশুদ্ধি ও তৃপ্তি সম্পন্ন হবে। যখন ঈমানের মাইলফলকগুলো নবায়ন করা হবে। যা কিছু নষ্ট হয়েছে, তা সংস্কার করা হবে। যেসব রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে তা সারিয়ে তোলা হবে। রমাদান সেই আধ্যাত্মিক মূহুর্ত যেখানে মুসলিম উম্মাহ তাদের বিভিন্ন অবস্থা সংস্কার করার সুযোগ পায়, তাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পায়। আর এ আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনা প্রতিটি জাতিরই কর্তব্য। মুসলমানরা এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে অধীর আগ্রহে। এটা ঈমান নবায়নের একটা বিদ্যাপীঠ। চরিত্র মাধুর্যমন্ডিত করার সময়। আত্মাকে শানিত করার সময়। নাফসকে ইসলাহ করার সময়। প্রবৃত্তিকে কনট্রোল করার সময়। কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার সময়”।
এই সুবর্ণ সুযোগ মুমিন অবহেলা করতে পারে না। বরং সে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে প্রভুর নৌকট্য লাভে সৎকর্মের ময়দানে যুদ্ধরত সৈনিকের মত, বজ্রকঠোর প্রতীজ্ঞা আর অপরাজেয় প্রতিযোগিতার চেতনায়। যেমনিভাবে স্বয়ং স্রষ্টা ও তাঁর রাসূল (স.) নির্দেশ করেছেন।
“وَفِي ذلِكَ فَلْيَتَنَافِسِ الْمُتَنَافِسُوْن”
“আর প্রতিযোগিতাকারীদের উচিৎ এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা” (আল-মুতাফফিফীণ:২৬)। রাসূল (স.) বলেন:
افْعَلُوا الْخَيْرَ دَهْرَكُمْ ، وَ تَعَرَّضُوا لِنَفَحَاتِ رَحْمَةِ اللهِ ، فَإِنّ لله نَفَحَاتٍ مِّن رَّحْمَتِهِ يُصِيْبُ بِهَا مَن يَّشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَ سَلُوا اللهَ أن يَّسْتُرَ عَوْرَاتِكُمْ وَ أَن يُّؤَمِّنَ رَوْعَاتِكُمْ

“তোমরা সর্বদা ভালো কাজ কর। আর আল্লাহর অপার রহমাতভরা বিশেষ বিশেষ সময়গুলোকে কাজে লাগাও। আল্লাহ তাঁর এ সব রহমাত দিয়ে বান্দাদের মধ্যে যাকে খুশি ধন্য করেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর, তিনি যেন তোমাদের অবাঞ্জিত জিনিসগুলোকে ঢেকে রাখেন এবং তোমাদেরকে ভয়-ভীতি থেকে নিরাপত্তা দান করেন”।
তবে সেজন্য দরকার সঠিক পূর্ব প্রস্তুতির মাধ্যমে রমাদানকে স্বাগত জানাতে উদ্যোগী হওয়া।

রমাদানকে স্বাগত জানানো রাসূলের সুন্নাত:

রমাদানের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ ও তাকে মনেপ্রাণে স্বাগত জানানো রাসূলের সুন্নাত। রাসূল (স.) রমাদানকে স্বাগত জানাবার জন্য প্রায় পুরো শাবান মাস জুড়েই রোযা পালন করতেন। যেমনটি হযরত ‘আইশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবা-তাবেয়ীদের রমাদান পূর্ব প্রস্তুতিও ছিল এ সুন্নাতেরই ধারাবাহিকতা।

রমাদানকে স্বাগত জানানোর পূর্বপ্রস্তুতিসমূহ:
রমাদানকে স্বাগত জানাতে আমাদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত? কিভাবে আমরা বরণ করব এ মহিমান্বিত মাসকে?
এখন আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করবো।
এক. রমাদান পাওয়ার জন্য দু‘আ করা:
‘হে রব! আমাদেরকে রমাদান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। আমরা যেন সুস্থতার সাথে রমাদানকে তোমার সন্তোষজনক পন্থায় উদযাপন করতে পারি। এর প্রতিটি মূহুর্ত থেকে ঈমানের পাথেয় সঞ্চয় করতে পারি’।
প্রত্যেক মুমিনের উচিত প্রাণ খুলে এ মাসের বরকত আহরণের জন্য আল্লাহর দরবারে এভাবে প্রার্থনা করা। রাসূল (স.) ও সাহাবীরা (রা.) এ দু‘আ করতেন। এ মর্মে ইমাম তাবারানী হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। নবী (স.) রজব মাসের পদার্পণে এ দু‘আ করতেন,
اَللّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَب وَشَعْبَان وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ .
“হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবানে তুমি বরকত দাও। আমাদেরকে রমাদান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও”।
হযরত মুঅল্লা বিন আল-ফাদল বলেন:
كَانُوْا ” يعني الصحابة ” يَدْعُوْنَ اللهَ سِتَّةَ أَشْهُرٍ أَن يُّبَلِّغَهُمْ رَمَضَانَ ، ثُمَّ يَدْعُوْنَهُ سِتَّةَ أَشْهًرٍ أَن يَّتَقَبَّلَهُ مِنْهُمْ .
সাহাবাগণ ছয় মাস আল্লাহ কাছে দু‘আ করতেন যেন রমাদান মাস পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে পৌঁছিয়ে দেন। আর ছয় মাস দু‘আ করতেন যেন, তাদের ইবাদাত আল্লাহ কবুল করেন”।
হযরত ইয়াহইয়া বিন আবি কাসির বলেন:
كَانَ مِنْ دُعَاِئِهْم : اللهمَّ سَلِّمْنِيْ إِلَى رَمَضَانَ، اللهمَّ سَلِمْ لِي رَمَضَانَ، وتسلمه مني متقبلاً.
“তারা এভাবে দু‘আ করতেন: “হে আল্লাহ! আমাকে রমাদান পর্যন্ত নিরাপদে রাখ। রমাদানকে আমার জন্য নিরাপদে রাখ। আমার রমাদানকে তুমি কবুল কর”।
দুই. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাভারে আনত হওয়া:
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রমাদানের মত একটি সুমহান মাস দান করেছেন। সেজন্য আমাদের উচিত তাঁর প্রতি হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভক্তি-অনুরাগ নিঃসারিত করে কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। শুকরিয়া দ্বারা নিয়ামত স্থায়ী ও বর্ধিত হয়। কুরআনে বলা হয়েছে,
لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন’ (সূরা ইব্রাহীম:৭)।
এজন্য একজন মনিষী বলেছেন, قيد النعمة بالشكر“শুকরিয়ার শিকল দিয়ে নিয়ামতকে বন্দী করে রাখ”। তাছাড়া, কত মানুষ আছে রমাদানের প্রতীক্ষায় থাকে, কিন্তু তার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিংবা মৃত্যু বরণ করে। গত বছর এই দিনে এমন অনেক লোক ছিল, যারা আজ আমাদের মাঝে নেই। চিরবিদায় নিয়ে পরকালে চলে গেছে। পৃথিবীতে প্রতি অর্ধসেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায়। ঘন্টায় প্রায় ৩৬০০ লোক মৃত্যু বরণ করে। প্রতি মিনিটে গর্ভজনিত জটিলতায় মারা যায় একজন নারী। এভাবে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে হায়াত দারাজ করেছেন। আমরা রমাদান পালন করার সুযোগ পেতে যাচ্ছি। সেজন্য মহান মনিবের সমীপে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা পেশ করা উচিত। রমাদান বরণের এটি একটি অন্যতম উপাদান। আরো মনে রাখতে হবে কৃতজ্ঞতা তখনই অর্থবহ হয়, যখন তার মধ্যে পাঁচটি জিনিস পাওয়া যায়:
ক. নিয়ামাতের স্বীকৃতি;
খ. নিয়ামাত দাতার প্রশংসা;
গ. নিয়ামাত দাতার প্রতি ভালোবাসা;
ঘ. নিয়ামাত দাতার প্রতি আনুগত্য;
ঙ. নিয়ামাত দাতার নিয়ামাতকে তার সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যবহার করা;

তিন. আনন্দানুভূতির বহিঃপ্রকাশ:
রমাদানের আগমন মুমিনের জন্য আসমানী সুসংবাদ। তাই এ মাসের আগমনে আনন্দানুভূতি ও গভীর সন্তোষের বহিঃপ্রকাশ থাকা উচিত আমাদের আচার-আচরণে, কথায়-কর্মে। পরস্পরের মধ্যে এ উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের আদান-প্রদান করা উচিত। আল্লাহর নিয়ামত পেয়ে আনন্দিত হয় না, কোন মুমিন কি এমন হতে পারে? এ দিকে ইঙ্গিত করেই ইরশাদ হয়েছে,
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ
“বল, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়’। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম” (ইউনূস:৫৮)।
রাসুল (স.) সাহাবীদেরকে এ মাসের সুসংবাদ দিতেন। এর প্রতিটি মূহুর্তকে কাজে লাগাবার জন্য উৎসাহিত করতেন। হাদীসে রয়েছে,
عن أبي هريرة ـ رض ـ قال: قال نبيُّ اللهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ، وهو يبشِّرُ أصحابَهُ: قَدْ جَاءَكُمْ رَمَضَانُ؛ شَهْرٌ مُبَارَكٌ افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلُّ فِيهِ الشَّيَاطِينُ، فِيهِ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ؛ مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ .
হযরত আবু হরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর নবী (স.) (সাহাবীদের সুসংবাদ দিতে গিয়ে বলেন), “তোমাদের কাছে রমাদান আগমন করেছে। পবিত্র মাস। আল্লাহ তোমাদের উপর এর সিয়াম ফরজ করেছেন। এ সময় জান্নাতের দুয়ারগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দুয়ারসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এ মাসের মধ্যে এমন একটি রজনী আছে, যা সহ¯্র মাসের চেয়ে উত্তম। যে এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে (সকল কল্যাণ থেকে) বঞ্চিত হলো ”।
হাফিজ ইবনি রাজাব আল-হাম্বলী তার ‘লাতাইফুল মা‘আরিফ’ নামক গ্রন্থে বলেন,
قال بعضُ العلماءِ: هذا الحديثُ أصلٌ في تهنئةِ النّاسِ بعضِهم بعضاً بشهرِ رمضانَ
“কতিপয় আলেম বলেছেন, এই হাদীসটি রমাদান মাস উপলক্ষ্যে পরস্পরকে অভিনন্দন জানানোর প্রমাণ”।
হযরত ইবনু ‘উমার (রা.) বলতেন:
مرحباً بشهرٍ خيرٌ كلُّه؛ صيامٌ نهارُه، قيامٌ ليلُه
“ঐ মাসকে স্বাগতম, যার সবটুকুই কল্যান। যার দিবস সিয়াম। যার রজনী কিয়াম”।
ইবনু রজব আরো বলেন,
“كيف لا يُبشَّر المؤمنُ بفتح أبواب الجنان؟! كيف لا يبشر المذنب بغلق أبواب النيران؟! كيف لا يبشر العاقل بوقت يُغَلُّ فيه الشيطان؟! من أين يشبه هذا الزمانَ زمان؟!”.
“মুমিন কিভাবে আনন্দিত না হয়ে পারে জান্নাতের দুয়ার খুলে দেয়া হলে? কিভাবে গুনাহগার আনন্দিত না হয়ে পারে, জাহান্নামের দুয়ার বন্ধ করা হলে? বুদ্ধিমান কি আনন্দিত না হয়ে পারে, শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হলে? এই সময়ের সাথে অন্যকোন সময়ের তুলনা হয়? ”
রমাদান মানুষের জন্য যে সব সুসংবাদ বয়ে আনে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১. কুরআনের মাস: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَان
“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে” (বাকারাহ:১৮৫)।
আল্লামা ইবনু কাসীর বলেন,
“يمدح – تعالى – شهرَ الصيام من بين سائر الشهور، بأنِ اختاره من بينهن لإنزال القرآن العظيم”.
“আল্লাহ অন্যান্য মাসের মধ্যে সিয়াম মাসের বিশেষ মর্যাদা তুলে ধরছেন। কারণ এ মাসকেই তিনি কুরআন নাযিল করার জন্য পছন্দ করেছেন”।
২. মুমিনকে গুনাহমুক্ত করে : এ মর্মে রাসূল (স.) বলেন,
من صام رمضان إيمانًا واحتسابًا، غُفر له ما تقدَّم من ذنبه
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের (আত্মপর্যালোচনা/নিষ্ঠা/সাওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে ) সাথে রোযা রাখে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়”। মুখারী-মুসলিম।
ইমাম কুরতুবী বলেন,
“قيل: إنما سمي رمضان؛ لأنه يَرمَض الذنوب؛ أي: يحرقها بالأعمال الصالحة”.
রমাদানকে এজন্য এ নামে নামকরণ করা হয়েছে, কারণ তা গুনাহরাজিকে নেক আমল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় – এ মর্মে একটি মত রয়েছে।
৩. রমাদান জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস:
রাসূল (স.) ইরশাদ করেন:

إن لله – تعالى – عتقاءَ في كل يوم وليلة، لكل عبدٍ منهم دعوةٌ مستجابة
“রমাদানের প্রতিটি দিন-রাতে আল্লাহ অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। তাদের প্রত্যেকের দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন”।
৪. ইখলাসের প্রশিক্ষণ ও রিয়ামুক্তকরণ:
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,
يَتركُ طعامَه وشرابَه وشهوتَه من أجلي، الصيام لي، وأنا أجزي به، والحسنة بعشر أمثالها
(রোযাদার বান্দা) আমার জন্যই খাদ্য-পাণীয় ও প্রবৃত্তি বর্জন করেছে। রোজা আমারই জন্য। আমিই এর প্রতিদান দেব বা আমি নিজেই এর প্রতিদান। আর নেক আমল দশগুণে বর্ধিত হবে”।
এত সব সুসংবাদ বয়ে আনা সত্বেও কি মুমিন রমাদানের আগমনে আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে পারে?

চার. সমাজ জীবনে সবার সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করা:
শাবান রমাদানের প্রস্তুতির মাস। এ মাসের একটি অন্যতম পবিত্র রজনী হচ্ছে ১৫তম রজনী। এ রাত সম্পর্ক হাদীসে রয়েছে,
يطلع الله إلى جميعع خلقه ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجيمع خلقه، إلا مشرك أو مشاحن.
“এ রাতে আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি তাকান। অতঃপর মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষপোষষকারী) ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন”। হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে রমাদানকে বরণ করা এ হাদীসের একটি অন্যতম দাবী। কারণ, মুশরিক শিরক করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আর মুশাহিন বিদ্বেষের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ক্রমান্বয়ে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে আল্লাহ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই রমাদান থেকে কোন প্রকার সুফল লাভ করতে পারেনা।
তাই রমাদানকে বরণ করে নেয়ার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, মানবীয় পর্যায়ের সকল সম্পর্ককে সুসংহত ও উন্নত করা। যেমন, মানুষকে মাফ করে দেয়া, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, মনকে হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা-পরশ্রীকতরতা থেকে পবিত্র করা। এতে মন পবিত্র হয়। পবিত্র মন আসমানী শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হয়। আল্লাহর রহমান ও মাগফিরাতের যোগ্য হয়। আল্লাহ বলেন,
)فَاتَّقُواْ اللهَ وَأَصْلِحُواْ ذَاتَ بِيْنِكُمْ( [
“সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও” (আনফাল:১)।

পাঁচ. বিশুদ্ধ নিয়্যাত ও দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ:
‘আগামী রমাদানে আমি সর্বশক্তি ব্যয় করে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করব। ইবাদাতে উজ্জীবিত রাখব এ মহিমান্বিত মাসকে। সমস্ত খারাপ ও অপরাধের পথ বর্জন করব। এর প্রতিটি মূহুর্তকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে কাজে লাগাব’। এখন থেকেই এ রকম অভিপ্রায়, সংকল্প ও প্রতীজ্ঞা নিতে হবে। বরং তা পরিকল্পনা মাফিক বাস্তবায়নের প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণ হতে হবে। যা হবে রমাদানে আল্লাহর পক্ষ থেকে আহ্বানকারীর يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ، “হে পূণ্যবান সৎকাজে এগিয়ে যাও”, এ আহ্বানে সাড়া দেয়ার উদ্ভোধনী পদক্ষেপ। নিয়্যাত ও প্রতীজ্ঞার এই বিষয়টি মুমিনের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মানুষ জানে না সে কখন মারা যাবে? কখন তার আয়ু শেষ হয়ে যাবে? গত রমাদানেও আমাদের সাথে এমন অনেক মানুষ ছিল, আজকে তারা নেই। এভাবে হয়ত আমরাও আগামী রমাদানে থাকবনা। সত্যিই যদি আমরা জীবনের চূড়ান্ত সময়সীমা জানতাম, তাহলে মিথ্যা স্বপ্নের কুহেলিকায় ঘুরপাক খেতাম না।
কেউ যদি এ রকম নিয়্যাত করার পর রমাদান আসার আগেই মারা যায়, তাহলে আল্লাহ তাকে পূর্ণ আমলের পরিপূর্ণ প্রতিদান দেবেন। এ মর্মে বুখারী-মুসলিমের হাদীসে রয়েছে,
إن الله كتب الحسنات والسيئات ثم بين ذلك ، فمن هم بحسنة فلم يعلمها كتبها الله له عنده حسنة كاملة ..
“আল্লাহ তা‘আলা পূণ্য ও পাপসমূহ লিখে তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। অতএব, যারা পূণ্য সাধনের সংকল্প করল কিন্ত তা করতে পারল না, আল্লাহর তাদের জন্য নিজের কাছে পরিপূর্ণ সাওয়াব লিখে রাখবেন”।
ইমাম বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূল বলেছেন:
إن ناسًا خلفنا بالمدينة ما سلكنا شعبًا ولا واديًا إلا وهم معنا حبسهم العذر
“মদীনায় কিছু মানুষ রয়ে গেছে। অথচ এমন কোন পথ বা উপত্যকা আমরা অতিক্রম করিনি, যেথায় তারা আমাদের সাথে নেই। ওজরের কারণে আমাদের সাথে আসতে পারেনি”।
প্রতীজ্ঞা-প্রত্যয়ে যারা সত্যবাদী তাদের সাফল্য যে অনিবার্য সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলছেন,
فَإِذَا عَزَمَ الْأَمْرُ فَلَوْ صَدَقُوا اللَّهَ لَكَانَ خَيْراً لَّهُمْ
“অতঃপর যখন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, তখন যদি তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা সত্যে পরিণত করত, তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত” (মুহাম্মাদ:২১)।
ছয়. রমাদানের সময়সূচি অনুযায়ী নিজের জীবন ও কর্মতৎপরতা পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনা গ্রহণ:
রমাদান মাসে করণীয় ইবাদাতের সময়সূচী অনুযায়ী নিজের জীবন প্রবাহ ও কর্মতৎপরতাকে পুনর্গঠনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সেগুলোকে এমনভাবে বিন্যাস করতে হবে, যাতে রমাদানের সাথে সংঘর্ষমুখর না হয়।
সাত. খাঁটি তাওবাহ করা:
গুনাহ থেকে তাওবাহ করা সর্বাবস্থায়ই ফরজ। এ মর্মে কুরআনে বলা হয়েছে,
“وتوبوا إلى الله جميعا أيها المؤمنون لعلكم تفلحون”
“হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার” (আননূর:৩১)।
কিন্তু রমাদানের প্রাক্কালে এর অপরিহার্যতা আরো বৃদ্ধি পায়। কারণ এটি হলো ইবাদাত-আনুগত্যের ভরা মৌসুমে পদার্পণের পূর্ব মূহুর্ত।
আর এ কথা সত্যি যে, পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি আনুগত্য করার তাওফীক লাভ করতে পারে না। পারে না প্রভুর সান্নিধ্য পাওয়ার যোগ্য হবে। কারণ, গুনাহ মানুষকে আল্লাহর রহমাত থেকে সরিয়ে রাখে। হৃদয়ে কাঠিন্য ও অন্ধকার সৃষ্টি করে। আল্লারহ সাথে দুরত্ব এনে দেয়। সে ব্যক্তি কিভাবে আল্লাহর সাথে গভীর প্রেমে মগ্ন হবে, যার তার দেহ-মন নাপাকী ও কদর্য্যতায় মলিন হয়ে আছে? এমন ব্যক্তি যদি কখনো ইবাদাত করেও, তাতে তার অনেক কষ্ট হয়। ইবাদাতকে তার কাছে বড্ড অসহ্য লাগে। যে তাতে কোন প্রকার আনন্দ উপভোগ করে না। ইবাদাতের নির্মল সৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আসলে গুনাহ হচ্ছে এক প্রকার শৃঙ্খল। এর নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে না পারলে ইবাদাত করা যায় না। এজন্যই এক ব্যক্তি যখন হাসান বসরী কে বলেছিলেন, আমি তাহাজ্জুদের নামায পড়তে পারি না। তিনি বললেন, কিভাবে পড়বে। গুনাহতো তোমাকে বন্দী করে রেখেছে। রমাদান পাওয়া সত্বেও ইবাদাতের পথে অগ্রগামী হতে গুনাহ যার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সে যে কত বড় হতভাগা তার প্রমাণ হচ্ছে ইমাম তবারানী কর্তৃক বিধৃত এ হাদীসটি:
جابر بن سمرة عن النبي صلى الله عليه وسلم: أتانِي جِبْرِيلُ فَقَالَ: يَا مُحمَّدُ! مَنْ أدْرَكَ أحَدَ وَالِدَيْهِ فَماتَ فَدَخَلَ النَّارَ فأبْعَدَهُ الله قُلْ: آمِينَ فَقُلْتُ: آمِينَ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ مَنْ أدْرَكَ شَهْرَ رَمَضَانَ فَمَاتَ فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ فأُدْخِلَ النَّارَ فأَبْعَدَهُ الله قُلْ: آمِينَ فَقُلْتُ: آمِينَ قَالَ: وَمَنْ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ فَمَاتَ فَدَخَلَ النَّارَ فأبْعَدهُ الله قُلْ: آمِينَ فَقُلْتُ: آمِينَ
হযরত জাবির বিন সামুরা (রা.) রাসূল (স.) থেকে বর্ণনা করেন, “আমার কাছে একদা জিব্রাইল আগমন করলেন। বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা কাউকে জীবিত পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রমাদান মাস পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তির সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হলো, কিন্তু আপনার উপর দরুদ পড়ল না, অতঃপর মৃত্যু বারণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন”।
বসন্ত কালেও যদি গাছে ফুল না ফোটে, তাহলে কখন আর ফুটবে? সাগরের পানি দিয়েও যার ময়লা দূর হয়না, তার ময়লা কি দিয়ে আর দূর হবে?
অনেকে মনে করে যে, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, হে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দাও -এ জাতীয় কতগুলো কথা বললেই আল্লাহর উপর তাকে মাফ করে দেয়া ওয়াজিব হয়ে যায়। আসলে বিষয়টি এ রকম নয়। এ কথার সাথে বান্দার সততার নিদর্শন থাকতে হবে। সত্যিই যে সে গভীরভাবে অনুতপ্ত এবং আল্লারহ কাছে ক্ষমাপ্রার্থী , তা প্রমাণ করতে হবে। সে জন্য মানুষের হক ফিরিয়ে দেয়া, বারবার মনিবের সকাশে ঐকান্তিকভাবে আকুতি জানানো, চোখের পানিতে মনের কালিমা মুছে দেয়ার উপর্যুপরি চেষ্টা, লজ্জিতভাবে ক্ষমা চাওয়া, জীবনে আর এ অপরাধ করবেনা এ মর্মে আল্লাহকে কথা দেয়া – এ সব লক্ষ্য রাখা বাঞ্জনীয়।
রমাদানের শুরুতে যে সব অপরাধ থেকে বিশেষভাবে তাওবাহ করা ওয়াজিব, সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে হারাম মালের কথা। হারাম ও অবৈধ উপার্জন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবনে আল্লাহর গজব ও বিপর্যয় ডেকে আনে। যে কারণে তার কোন দ‘ুআ কবুল হয়না। এ প্রসঙ্গে ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (স.) বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ؛ فَقَالَ: ) يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ ( [المؤمنون:৫১]، وَقَالَ: )يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ( [البقرة: ১৭২]. ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ، أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ؛ يَا رَبِّ! يَا رَبِّ! وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ؛ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟

“হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলদের। তিনি বলেছেন, “ হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভাল বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সর্ম্পকে আমি সম্যক জ্ঞাত” (আল-মুমিনুন:৫১)। তিনি আরো বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি” (আল-বাকারাহ:১৭২)। অতঃপর রাসূলে কারীম (স.) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধুলিধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে, হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ!। অথচ, সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবূল হবে?!
অতএব, হে আল্লাহর বান্দা নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখ, ঘরের মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখ, পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেখ, ব্যাংকের একাউন্ট চেক করে দেখ, কোথাও এমন কোন মাল আছে কিনা যা তোমার জন্য হালাল নয়, হারাম। হারাম পাওয়া গেলে সেগুলো বের করে দাও। নিজেকে, নিজের সম্পদকে পবিত্র কর। হারাম থেকে পবিত্র হও, যেন তোমাকে এসে মহান অতিথি সততার উপর প্রতিষ্ঠিত পায়, তাহলে তুমি হবে ¯্রষ্টার একান্ত প্রিয় পাত্র।
টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, খুন-গুম, হত্যা-ধর্ষণ, জাতীয় অর্থ লোপাট, শেয়ার বাজার হরিলুট, ধোকা-প্রতারণা, মজুদদারী, কৃত্রিম ভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মিথ্যা ভাউচার, মামলা-গ্রেফতার, রিমান্ড, ভর্তি ও চাকরী বাণিজ্য, বেতন ছাড়া কর্মচারী খাঁটিয়ে ইত্যাদি উপায়ে অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ে যারা কালো টাকা সাদা করার কথা ভাবছে, তাদের জন্য রমাদানপূর্ব এই সময় তাওবাহ করার সর্বোত্তম সুযোগ। প্রাপকদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে সততা ও হালাল উপার্র্জনের পথে ফিরে আসার এখনই সময়।

আট. সিয়ামের বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা:
রমাদানকে সাদরে বরণ করে নেয়ার অন্যতম একটি করণীয় হলো, সিয়াম শুরু হওয়ার আগেই এর যাবতীয় বিধি-বিধান তথা মৌলিক মাসআলা- মাসাইল সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা। সিয়ামের ফরজ-সুন্নাহ, রুকন-শর্ত, অদাব, কি কি কাজ করলে রোযা বিনষ্ট হয়ে যায় ইত্যাদি এ পর্যায়ের অন্তর্গত। এভাবে সিয়াম সাধনা হবে বিশুদ্ধ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। মুসলমান তার দ্বীন সম্পর্কে থাকবে সম্যক জ্ঞানের অধিকারী, দায়িত্ব সম্পর্ক থাকবে সচেতন ও স্বচ্ছ ধারণাসমৃদ্ধ, এমনটিই ইসলামের নির্দেশনা। বিশেষ করে ফরজ দায়িত্ব। কারণ মূর্খতা ও অজ্ঞতার দোহাই দিয়ে এ দায়িত্ব থেকে বাঁচার কোন সুযোগ নেই। এজন্য ইরশাদ হয়েছে: فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ “তোমরা যদি না জানো, তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর” (আন-নাহল:৪৩)। মূলত যারা ধর্মীয় জ্ঞানে গভীরতা অর্জন করে, তারাই প্রকৃত ভাগ্যবান, তারাই শ্রেষ্ঠ। রাসূল (স.) বলেন,
مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ.
“আল্লাহ যার কল্যাণ সাধন করতে চান, তাকে ধর্মের গভীর জ্ঞান দান করেন” (বুখারী-মুসলিম)।
বর্তমান যুগে নির্ভরযোগ্য আলেম, গবেষক ও আলোচকদের সিডি, ক্যাসেট থেকেও এ সব বিষয়ে প্রভুত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে যাদের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে রয়েছেন আল্লাম দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী। তিনি তাঁর ভাষণ-বক্তৃতার মাধ্যমে বাংলা ভাষা-ভাষীদের জন্য ইসলামী জ্ঞানের এক মহাভান্ডার ও বিশ্বকোষ উপহার দিয়েছেন, যার আবেদন যুগ যুগ ধরে শেষ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা তাকে হেফাজাত করুন। এ সব সিডি-ক্যাসেট পরস্পর আদান-প্রদান করেও আমরা ইসলামী দাওয়াতের মহান দায়িত্ব পালন করতে পারি।
নয়. বিশেষ বিশেষ কাজের অভ্যাস গড়ে তোলা:
ক. শাবানের সিয়াম: যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ পূর্ণাঙ্গ নৈপুণ্যের সাথে সম্পাদন করার লক্ষ্যে পূর্ব থেকেই এর অনুশীলন করতে হয়। এ কারণেই রাসূল শাবানের রোযা রাখতেন। ফলে রমাদানের রোজা আসার আগেই দেহ-মন রোজায় অভ্যস্ত হয়ে যেত। রমাদানের রোজা তখন আর কষ্ট বা ক্লান্তিকর মনে হত না। আমাদেরও এ অভ্যাসটি গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত।
খ. রাত্রি জেগে নামায পড়া: রমাদানে দুটি কিয়ামুল লাইল আছে। একটি তাবারীহ। অন্যটি তাহাজ্জুদ। রামাদান যেহেতু জীবনের মহাসুযোগ। তাই তারাবীহর পাশাপাশি খাঁটি মুমিনরা তাহাজ্জুদও পড়েন অত্যন্ত যতœশীলতার সাথে। কিন্তু হঠাৎ করে কোন কাজ করা বড় কঠিন। পূর্ব অভ্যাস এ ক্ষেত্রে কাজটিকে অনেক সহজ করে দেয়। তাই রমাদানের আগে থেকেই রাতজেগে নামায পড়ার কিছু কিছু অভ্যাস গড়তে পারলে রহমাতের মৌসুমে তা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এ অভ্যাস মুমিনের পার্থিব জীবনে জান্নাতের পরশ বুলিয়ে দেয়। রচনা করে তার সামনে সাফল্যের এক মহাসড়ক। এজন্যই রাসূল (স.) বলেছেন,
عليكم بقيام الليل فإنه دأب الصالحين قبلكم ، وقربة إلى الله تعالى ، ومنهاة عن الإثم ، وتكفير للسيئات ، ومطردة للداء عن الجسد
“তোমরা কিয়ামূল লাইল কর। কারণ এটি তোমাদের পূর্ববর্তী পূণ্যবানদের অভ্যাস। আল্লাহর সান্নিধ্য। অপরাধ থেকে নিবৃত্তি। গুনাহের জন্য কাফফারাহ। দেহ থেকে রোগ অপসারণকারী”।
গ. কুরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস:
রমাদান কুরআনের মাস। কুরআনের কারণেই রমাদানের মহাসম্মান। তাই রমাদানের মাহাত্ম্য অর্জনে কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সেজন্য চাই কুরআন চর্চা ও তিলাওয়াতের সাথে এ মাস আসার পূর্বেই গভীর সখ্যতা ও ভালোবাসার বন্ধন রচনা করা।
ইবনে রজব আল-হাম্বলী বলেন,
” ولما كان شعبان كالمقدمة لرمضان شرع فيه ما يشرع في رمضان من الصيام وقراءة القرآن ليحصل التأهب لتلقي رمضان وترتاض النفوس بذلك على طاعة الرحمن روي عن أنس قال: ” كان المسلمون إذا دخل شعبان انكبوا على المصاحف فقرؤها، وأخرجوا زكاة أموالهم تقوية للضعيف والمسكين على صيام رمضان”.
“শাবান যেহেতু, রমাদানের ভূমিকাস্বরূপ, তাই রমাদানে যা কিছু শরীয়তসিদ্ধ, শাবানেও তা-ই শরীয়তসিদ্ধ। যেমন, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত। যাতে রমাদানকে গ্রহণ করে নেয়ার প্রস্তুতি অর্জিত হয়। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি নাফস বশীভূত হয়। হযরত আনাস বলেন, শাবান মাসের আগমন হলেই মুসলমানরা কুরআন নিয়ে ব্যপৃত হয়ে পড়তো। কুরআন পাঠ ও চর্চা করত। মালের যাকাত বের করত। দুর্বল ও মিসকীনরা যেন রমাদানের সিয়াম পালন করার সামর্থ্য লাভ করতে পারে”।

সালামাহ বিন কুহাইল (سلمة بن كهيل) বলেন, كان يقال شهر شعبان شهر القراء. “শাবানকে বলা হতো, কারীদের (কুরআন তিলাওয়াত ও চর্চাকারীদের) মাস”।
আল-হাসান বিন সাহল ( قال الحسن بن سهل) বলেন,
” قال شعبان: يا رب جعلتني بين شهرين عظيمين فما لي؟ قال: جعلتُ فيك قراءة القرآن
শাবান বলেছিল, হে আল্লাহ! আমাকে তুমি দুটো মহনা মাসের মধ্যে রেখেছ। আমার জন্য কি আছে? আল্লাহ বললেন, তোমার মধ্যে রেখেছি কুরআন পঠন”।
ঘ. ওয়াজিব সমূহের প্রতি গুরুত্বারোপ: যেমন, জামাতের সাথে ফজরসহ অন্যান্য নামায আদায়। তাহলে রমাদানেও জামাত ছুটে যাওয়ার সম্ভাবন থাকবে না।
ঙ. বদঅভ্যাসসমূহ পরিত্যাগ করা এবং সদাভ্যাস ধারণ করা:
মানুষ অভ্যাসের দাস নয়; বরং অভ্যাসই মানুষের দাস। এ কথা সিয়াম সাধনার দ্বারা প্রমাণিত হয়। তবে সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় আগেভাগেই। তাই সিয়াম সড়কে আমাদের যাত্রা শুরু হোক সকল বদাভ্যাস মুক্ত হয়ে সদাভ্যাসের শুভ্র পোশাকে অলংকৃত হয়ে।
দশ. মুহাসাবতুন নাফস বা আত্ম পর্যালোচনা:
জবাবদিহিতাশুন্য, বলগাহীন, যথেচ্ছ জীবন যাপন করা মুমিনের পরিচয় নয়। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহিতা করার পূর্বেই মুমিন নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করে। অতীতের ভুল-ভ্রান্তির অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে করে সত্যের আভায় উদ্ভাসিত। ভুল পেড়িয়ে নির্ভুল, আধার মাড়িয়ে আলোর পথে পৌঁছাতে তার চেষ্টার অন্ত নাই। আত্মসংশোধনের এই চলমান প্রক্রিয়ার নাম ইসলামের ভাষায় মুহাসাবাতুন নাফস। কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে এ দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে কতই না অনুপম শৈলিতে। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত” (সূরা আল-হাশর:১৮) ।
রাসূল (স.) ইরশাদ করেন:
الكيّس من دان نفسه، وعمل لما بعد الموت والعاجز من أتبع نفسه هواها وتمنى على الله الأماني
“প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে আত্মপর্যালোচনা করে। এবং মৃত্য পরবর্তী জীবনের জন্য শ্রম করে। আর অক্ষম/নির্বোধ ঐ ব্যক্তি যে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছে শুধু পাওয়ার আকাঙ্খা করতে থাকে”।
এ জন্য রমাদান আসার আগেই প্রত্যেক মুমিনের উচিত আত্মসমালোচনা করা। গত রমাদানে আমার কর্মপন্থার মধ্যে কি কি ঘাটতি ছিল? কেন আমি কাঙ্খিত মাত্রায় ইবাদাত করতে পারিনি? কি কারণে আমি সিয়াম থেকে সর্বোচ্চ মাত্রায় লাভবান হতে পারিনি? কি করলে ভালো হতো? সিয়াম আরো অর্থবহ ও শিক্ষণীয় হতো? এসব বিষয়ে আত্মসমালোচনা করে যথাযথ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা রমাদানপূর্ব প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

উপসংহার:
মোট কথা, অতীতের সমস্ত গ্লানী, পাপাচারের কালীমা ও ব্যর্থতার পিছুটান থেকে মুক্ত হয়ে এক নতুন জীবনধারা গড়তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সকলের সাথে সম্পর্কের নতুন পাতা খুলতে হবে। নতুন পাতা আল্লাহর সাথে, তাঁর আনুগত্যের শপথ নিয়ে, নাফরমানি বর্জনের ঘোষণা দিয়ে। নতুন পেইজ রাসূলের সাথে। তাঁর আদর্শ ধারণের মাধ্যমে। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। প্রত্যেকের হক যথার্থভাবে আদায় করে। সমস্ত মুসলমানের সাথে। ন্যায়ানুগ আচরণ ও মানবকি মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে।
আমাদের দেশে রমাদানকে সামনে রেখে দু’ধরনের প্রস্তুতি চলে। এক. অধিক পরিমাণে খাদ্য মজুত করার প্রস্তুতি। দুই. অধিক পরিমাণে ইবাদাতের মাধ্যমে রমাদানকে বরণের প্রস্তুতি। যেমন, বেশি বেশি নফল, কিয়ামূল লাইল, দান-খয়রাত করার অব্যাহত প্রচেষ্টা, হারাম বর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা ইত্যাদি। এতক্ষণ আলোচনা থেকে বুঝা গেল শেষোক্ত প্রস্তুতিই হচ্ছে মুমিনের আদর্শ। আর ইবাদাতের চেতনাহীন শুধু খাবার-দাবারের প্রস্তুতি হচ্ছে মুসলিম নামধারী ভোগবাদীদের আদর্শ। যারা ইসলামকে শুধু কিছু প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া অন্যকিছু মনে করেনা। যাদের আরেক নাম ধর্মনিরপেক্ষাবদী। এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন, আপনার প্রস্তুতি কেমন হবে? কিভাবে হবে?
আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন।

রমাদানের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নেবেন যেভাবে।। শায়েখ ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী। অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।

About The Author
-

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>