তাওহীদ (আল্লাহর এককত্ব)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
তাওহিদে রুবুবিয়্যাহ: অর্থাৎ আল্লাহর যাবতীয় কর্মে তাঁকে এক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। যেমন- সৃষ্টি করা, মালিকানা (সার্বভৌমত্ব), নিয়ন্ত্রণ করা, রিযিক দেয়া, জীবন দেয়া, মৃত্যু দেয়া, বৃষ্টিপাত করা ইত্যাদি। সুতরাং আল্লাহকে সবকিছুর রব, মালিক, সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে; জীবন ও মৃত্যুদাতা, উপকার ও ক্ষতিকারী, দুআ কবুলকারী, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী, সকল কল্যাণের অধিপতি, স্ব-ইচ্ছা বাস্তবায়নে ক্ষমতাবান হিসেবে বিশ্বাস না করলে একত্ববাদের ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। এর মধ্যে তাকদীর তথা ভাল-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এ ঈমানও অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রকারের তাওহিদের ক্ষেত্রে মক্কার কাফেরগণ আপত্তি করেনি; যাদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছিলেন। বরং তারা সামষ্টিক বিচারে তাওহিদে রুবুবিয়্যাতে স্বীকৃতি দিত। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন কে নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, এগুলো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ।”[সূরা যুখরুফ, আয়াত: ০৯] তারা স্বীকার করত যে, আল্লাহই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী। তাঁর হাতে রয়েছে আসমান ও জমিনের রাজত্ব। এর থেকে জানা গেল যে, আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের এতটুকু স্বীকৃতি ইসলাম গ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং এ ঈমান অন্য যে ঈমানকে আবশ্যক করে সে অংশের উপরও ঈমান আনতে হবে। সেটা হচ্ছে উলুহি্য়্যাত তথা উপাসনাতে আল্লাহর এককত্বের প্রতি ঈমান।
এ তাওহিদ অর্থাৎ তাওহিদে রুবুবিয়্যাকে বনি আদমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেউ অস্বীকার করেছে বলে জানা যায় না। এ কথা কেউ বলেনি যে, এ মহাবিশ্বের সমমর্যাদার অধিকারী একাধিক স্রষ্টা রয়েছে। তাই রুবুবিয়্যাকে কেউ অস্বীকার করেনি। শুধু অহংকার ও হঠকারিতা বশতঃ ফেরাউনের পক্ষ থেকে এ ধরনের অস্বীকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। বরং সে দাবী করেছিল সেই রব্ব। আল্লাহ তাআলা তার কথাটি উদ্ধৃত করে বলেন: “এবং বললঃ আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর রব্ব।”[সূরা নাযিআত, আয়াত: ২৪] “আমি জানি না যে, আমি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য আছে।”[সূরা কাসাস, আয়াত: ৩৮] এটি ছিল তার দাম্ভিকতা। কারণ সে জানত সে রব্ব নয়। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “তারা অন্যায় ও ঔদ্ধত্যভরে নিদর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করল যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল।”[সূরা নামল, আয়াত: ১৪] আল্লাহ তাআলা মূসার বিতর্কের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: “তুমি জান যে,আসমান ও যমীনের রব্ব ছাড়া অন্য কেউ এসব নিদর্শনাবলী নাযিল করেননি।”[সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১০২] তাই সে মনে মনে স্বীকার করত যে, রব্ব হচ্ছেন- আল্লাহ তাআলা।
রুবুবিয়্যাহকে শিরকের মাধ্যমে অস্বীকার করে- মাজুস বা অগ্নি উপাসকেরা। তারা বলে, এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা দুইজন: অন্ধকার ও আলো। তবে এ বিশ্বাস সত্ত্বেও তারা এ দুই স্রষ্টাকে সমান মর্যাদা দেয়নি। তারা বলেছে: আলো আঁধারের চেয়ে উত্তম। কারণ আলো কল্যাণের স্রষ্টা। আর আঁধার অকল্যাণের স্রষ্টা। যে কল্যাণ সৃষ্টি করে সে অকল্যাণ সৃষ্টিকারীর চেয়ে উত্তম। অন্ধকার হচ্ছে- অনস্তিত্ব, অনুজ্জ্বল। আলো হচ্ছে- অস্তিত্বশীল ও উজ্জ্বল। তাই আলোর সত্তা অধিক পরিপূর্ণ।
মুশরিকদের রুবুবিয়্যতে বিশ্বাস করার অর্থ এই নয় যে, তাদের সে বিশ্বাস পরিপূর্ণ ছিল। বরং তারা মোটের উপর রুবুবিয়্যতে বিশ্বাসী ছিল। যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আমরা দেখেছি। কিন্তু তারা এমন কিছু বিষয়ে লিপ্ত হতো যেগুলো রুবুবিয়্যতের বিশ্বাসকে ত্রুটিপূর্ণ করে দেয়। যেমন- বৃষ্টি বর্ষণকে নক্ষত্রের সাথে সম্পৃক্ত করা; গণক ও যাদুকরেরা গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা; ইত্যাদি। কিন্তু উলুহিয়্যাতের শিরকের তুলনায় তাদের রুবুবিয়্যাতের শিরক ছিল খুবই সীমাবদ্ধ।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন মৃত্যু অবধি আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের উপর অবিচল রাখেন।
আল্লাহই ভাল জানেন।
দেখুন: তাইসীরুল আযিযিল হামিদ, পৃষ্ঠা-৩৩, আল-কাওলুল মুফিদ (১/১৪)।
পবিত্রতা
আলহামদুলিল্লাহ।
চামড়ার মোজা কিংবা কাপড়ের মোজার ওপর মাসেহ করার সময়কাল শুরু হয় প্রথমবার ওযু ভাঙ্গার পর প্রথমবার মাসেহ করা থেকে। প্রথমবার মোজা পরিধানের সময় থেকে নয়।
মাসেহ করার পদ্ধতি:
দুই হাতের ভেজা আঙ্গুলগুলো দুই পায়ের আঙ্গুলের ওপর রাখবে। এরপর হাত দুইটি পায়ের গোছার দিকে টেনে আনবে। ডান পা ডান হাত দিয়ে মাসেহ করবে; বাম পা বাম হাত দিয়ে মাসেহ করবে। মাসেহ করার সময় হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁকা ফাঁকা করে রাখবে। একাধিকবার মাসেহ করবে না।[দেখুন: শাইখ ফাউযানের ‘আল-মুলাখ্খাস আল-ফিকহি ১/৪৩]
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: অর্থাৎ মোজার যে অংশ মাসেহ করা হবে সেটা উপরের অংশ। শুধু পায়ের আঙ্গুলের দিক থেকে পায়ের গোছার দিকে হাত টেনে আনবে। একত্রে দুই হাত দিয়ে দুই পা মাসেহ করবে। অর্থাৎ ডান হাত দিয়ে ডান পা মাসেহ করবে এবং একই সময়ে বাম হাত দিয়ে বাম পা মাসেহ করবে। যেমনটি দুই কান মাসেহ করার ক্ষেত্রেও করা হয়। কেননা সুন্নাহ থেকে বাহ্যিকভাবে এটাই জানা যায়। দলিল হল মুগিরা বিন শুবা (রাঃ) এর উক্তি: “তিনি দুই পায়ের ওপর মাসেহ করেছেন”। তিনি এ কথা বলেননি যে, ডান পা দিয়ে শুরু করেছেন। বরং বলেছেন: “দুই পায়ের ওপর মাসেহ করেছেন”। এ কারণে সুন্নাহ থেকে বাহ্যিকভাবে এটাই জানা যায়। হ্যাঁ, যদি এমন হয় যে, তার এক হাত কাজ করে না সেক্ষেত্রে সে বাম পায়ের আগে ডান পা মাসেহ করে তাহলে ঠিক আছে। অনেক মানুষ দুই হাত দিয়ে ডান পা মাসেহ করে এবং দুই হাত দিয়ে বাম পা মাসেহ করে— এর কোন ভিত্তি নেই। তবে ব্যক্তি মোজার উপরের অংশ যেভাবেই মাসেহ করুক না কেন সেটা জায়েয হবে। আমরা এখানে যেটা আলোচনা করেছি সেটা হচ্ছে উত্তম পদ্ধতি কোনটি সে সম্পর্কে।[সমাপ্ত]
[দেখুন: ফাতাওয়াল মারআ আল-মুসলিম ১/২৫০]
মোজার দুই পার্শ্ব কিংবা পেছনের অংশ মাসেহ করবে না। যেহেতু এ বিষয়ে কোন দলিল নেই। শাইখ উছাইমীন বলেন: “কেউ হয়ত বলতে পারে যে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে মোজার ওপরের অংশ মাসেহ করার চেয়ে নীচের অংশ মাসেহ করা অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ নীচের অংশে মাটি ও ময়লা লাগে। কিন্তু, আমরা চিন্তাভাবনা করে পেয়েছি মোজার ওপরের অংশ মাসেহ করা অধিক যুক্তিযুক্ত এবং বিবেক-বুদ্ধিসম্মত। কারণ এ মাসেহ দ্বারা পরিষ্কার করা বা নির্মল করা উদ্দেশ্য নয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ইবাদত পালন করা। যদি আমরা মোজার নীচের অংশ মাসেহ করতাম তাহলে তো মোজা আরও বেশি ময়লা হয়ে যেত। আল্লাহই ভাল জানেন।
[দেখুন ‘আল-শারহুল মুমতি ১/২১৩]
আলহামদুলিল্লাহ।
সুন্নত হচ্ছে- বসে পেশাব করা। যদি কেউ দাঁড়িয়ে পেশাব করে তাতে কোন অসুবিধা নেই; যদি সে ব্যক্তি কাপড় ও পোশাককে নাপাকি থেকে বাঁচাতে পারে।
যদি কেউ দাঁড়িয়ে পেশাব করার পর নিশ্চিত হয় যে, তার কাপড়ে পেশাব লেগেছে তাহলে পেশাব লাগার স্থানটি ধুয়ে ফেলা আবশ্যক। নাপাকির স্থানে পানি ছিটিয়ে দেয়া কিংবা মুছে ফেলা যথেষ্ট নয়। বরং আবশ্যক হল ধুয়ে ফেলা ও পানি প্রবাহিত করা।
যদি কেউ সন্দেহ করে যে, তার কাপড়ে কি পেশাব লেগেছে; নাকি লাগেনি; সেক্ষেত্রে কাপড় ধৌত করা তার উপর আবশ্যকীয় নয়। কেননা মূল অবস্থা হচ্ছে- পোশাকের পবিত্রতা; যতক্ষণ পর্যন্ত না পোশাকে নাপাকি লাগার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
স্থায়ী কমিটির আলেমগণ বলেন: যদি আপনি পেশাবের ফোটা পড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন তাহলে ইস্তিনজা (পেশাব থেকে শৌচ করা), প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযু করা এবং পোশাকের যে স্থানে পেশাব লেগেছে সে স্থান ধৌত করা আবশ্যক। আর যদি সন্দেহ হয় সেক্ষেত্রে তার উপর সেটা আবশ্যক নয়। তবে, সন্দেহকে এড়িয়ে চলা উচিত; যাতে করে ব্যক্তি ওয়াসওয়াসাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে।[সমাপ্ত]
[ফাতাওয়াল লাজনাহ আ-দায়িমা (৫/১০৬)]
মানুষ তার দ্বীনের উপকারী বিষয়ে প্রশ্ন করতে দোষের কিছু নেই, এটি ওয়াসওয়াসা নয়। বরং এটি হচ্ছে- পরিপূর্ণভাবে দ্বীন পালনের চেষ্টা ও ভাল কাজের ব্যাপারে আগ্রহ।
আমরা আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে ও আপনাকে সকল ভাল কাজের তাওফিক দেন। নিশ্চয় তিনি সে ক্ষমতা রাখেন।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
আলহামদুলিল্লাহ।
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:
সঠিক মতানুযায়ী মাসেহ করার মেয়াদ শেষ হলেও ওজু ভাঙ্গবে না। অর্থাৎ যদি মাসেহ করার মেয়াদ দুপুর ১২ টায় শেষ হয়ে যায়; কিন্তু রাত পর্যন্ত আপনার পবিত্রতা ভঙ্গ না হয় তাহলে আপনি পবিত্রতার উপর রয়েছেন। কেননা মাসেহ করার সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে ওজু ভেঙ্গে যায় এই মর্মে কোন দলিল নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাসেহ করার সময়কাল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; কিন্তু তিনি পবিত্রতার সময়কাল নির্দিষ্ট করে দেননি। তালিবুল ইলমের উচিত এ নিয়মটি খেয়াল রাখা; সেটা হচ্ছে– যে জিনিস কোন শরয়ি দলিলের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে সেটা শরয়ি দলিল ছাড়া রহিত হবে না। কেননা মূলনীতি হচ্ছে– যেটা যে অবস্থায় আছে সেটা সে অবস্থায় অটুট থাকা।
আল্লাহ্ই অধিক জ্ঞাত।