বড় বড় আলিমগণের সাথে থেকেও কিছু মূর্খ বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষ আলিমের মত জ্ঞানী হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত ছিলেন আমাদের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার জনাব হাজি দেরাস্তুল্লাহ সাহেব রহিমাহুল্লাহ। ইন্তেকালের কিছুকাল আগে তিনি আমাদের জয়নগর মাদ্রাসায় বেড়াতে আসেন। যতটুকু মনে পড়ে আমি তখন ক্লাস সিক্স এ পড়ি।
ঐদিন আমাদের শেষ ক্লাসটা তার আগমনে বাতিল হলো। আমরা মাদ্রাসার আধাকাঁচা মসজিদে সালাতুয যুহর আদায়ের পরে বসে পাড়লাম। তিনি সুন্দর সুন্দর কিছু কথা বলে গেলেন আমাদের।
বললেন, ” দেখ আব্বারা, তোমরা যে সমাজে থাকবা, সেখানে এমন ভাবে ফুটে উঠবা, যেমন ভাবে একটা সুন্দর মুখে তার কালো তিলকটা ফুটে উঠে মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করে। একটা ফুটন্ত ফুলের মত যেন সুরভিত হয়ে ওঠো, যার ঘ্রাণে তোমার পাশে যেন সবাই ছুটে আসে।
তিনি বললেন, আমার খুব ঘৃণা লাগে যখন কোন মুসলিম বাড়িতে যাই। আর ছেলে বা মেয়ে তার আব্বাকে বাপ বা বাবা, আর আম্মাকে মা বা মাম বলে ডাকতেছো।মুসলিমদের এই ডাক ও হিন্দুদের ডাকের মধ্যে বলতো তা হলে পার্থক্য কি?
তিনি বললেন, দেখ, আব্বা আম্মা অনেক শ্রদ্ধার পাত্র। বাসায় যেয়ে তাদের সাথে তুমি তুমি করে কথা বলবেনা। তাদেরকে সম্মান দিয়ে আপনি আপনি করে কথা বলবা।আর, বাসায় যেয়ে তাদের কে আগে সালাম দিবা ও মাঝে মাঝে আব্বা আম্মার হাতে ও কপালে চুমা দিবা। খবরদার, তাঁরা যখন ডাকবে, অমনি ‘ওই’, অথবা ‘কিইইই’ বলে জবাব দিবানা, বলবা, ‘জি আব্বা’ বা ‘জি আম্মা’।
উনার আলোচনা শেষ হলো। আর আমি পড়লাম বিপদে। বাড়ির আমি বড় সন্তান। আব্বা আম্মাকে তখনো আমি বাপ ও মা বলে ডাকি, আর তুমি তুমি করে কথা বলি। আব্বা আম্মাকে সালাম দিতে খুবই লজ্জা করতো। কিংবা ভয় পেতাম খুব বেশি।
আমি বাড়ি গেলাম। মায়ের পাশে যেয়ে “আম্মা, আসসালামু আলাইকুম” বললাম। হাত ধরলাম, কিন্তু চুমা দেয়া হয়ে উঠলো না।
আনন্দে আমার আম্মা কেঁদে ফেললেন, বললেন, কি বললে? আবার বলো? আমি দৌঁড়ে পালালাম লজ্জায়। ঐ দিন বিকেল গেলো, রাত গেলো। সকালে লজ্জায় আম্মার পাশে যেতে পারছিনা। ভাবলাম কিছু না খেয়ে মাদ্রাসা যাবো। অমনি আম্মা হাত ধরলেন। বললেন, বাছা, আরেকবার আম্মা বলো। আমি ফিসফিসিয়ে আম্মা……… বলতেই দেখলাম তিনি একটা টাকা বের করে হাতে দিলেন, এবং শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণের জ্বলজ্বলে মুক্তকণা মুছলেন। আনন্দে জড়ায়ে ধরে তিনি আমাকে চুমা দিলেন। বললেন, যা শেখানো দরকার ছিলো আমাদের, তা তোমাকে কে শেখালো? আমি হাজি সাহেবের নাম বললাম। তিনিও সম্মানের সাথে বিস্ময়ের ঘোরে উচ্চারণ করলেন, হাজি দেরাস্তুল্লাহ, আল্লাহ তাকে কবুল করুন। আলহামদুলিল্লাহ, আমার পথ ধরে সব ভাইবোন গুলো কয়েকদিনেই আগের বদ অভ্যাস পরিবর্তন করে ফেললো।
আমি এখন আধুনিক ফ্যামিলি গুলো দেখি আর ভাবি যে কোথায় গেলাম আমরা? আব্বা ভুলে এখন ড্যাড, ড্যাডী, বাবা। আম্মাকে মাম, মা , মাম্মি ইত্যাদি এমন শব্দে ডাকছি যার সাথে না আছে আমাদের ঐতিহ্যের মিল, না আছে আরবির কোন সৌরভ। অথচ এখন শিক্ষিতের হার যথেষ্ঠ বেড়েছে, বেড়েছে আধুনিকতার ও ছায়া বা ছোঁয়া।