রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) অনেক অনেক উচু দরের মানুষ হলেও ছিলেন অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ। তাঁর আশেপাশের লোকজন সেটা টের পেতেন। তিনি এক সাথে খেতেন, বসতেন এবং চলাফেরা করতেন। সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন হিশাম বলেনঃ আমরা একবার নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) এর সাথে ছিলাম। আর তিনি ওমর বিন আল-খাত্তাবের হাত ধরে ছিলেন। তখন ওমর বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জান ছাড়া আপনি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) বললেনঃ না, যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হবো। তখন ওমর বললেনঃ ঠিক আছে, এখন ওল্লাহে, আপনি আমার কাছে আমার নিজের জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) বললেনঃ এখন হয়েছে, ওমর !! (বুখারীঃ ৬৬৩২)।
ইমানের দাবী হলো- যখন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আসবে, তখন তাঁকে ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) কে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসতে হবে। এই ভালোবাসায় ঘাটতি হলে ইমান যেমন পরিপূর্ণ হবে না, তেমনি আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিরও হুমকি দেওয়া হয়েছে। এটা আল্লাহ তায়ালার বিধান। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) নিজ থেকে এই ভালোবাসা দাবী করেন নি। সূরা আত-তাওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ – التوبة/24 .
আপনি বলে দিন যে যদি তোমাদের বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রীরা, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমরা যে মাল-সম্পদ কামাই করো, যে ব্যবসা-বানিজ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় করো এবং যে সমস্ত ঘর-বাড়ি তোমরা পছন্দ করো – এগুলো যদি তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদের চেয়ে, তাহলে অপেক্ষা করো যতক্ষণ আল্লাহ তাঁর আদেশ নিয়ে আসেন। আল্লাহ গোনাহগার জাতিকে সঠিক পথ দেখান না।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাছে প্রকৃতপক্ষেই কে বেশী ভালোবাসা পাবার যোগ্য তা পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন।
এই আয়াতের ভাষায় আল্লাহ একটা বিশেষদাবী নিয়ে একটু নিরাবেগ ভাষায় এমন ভালোবাসার কথা বলেছেন। এখানে আল্লাহ নিজে তাঁর ভালোবাসার অধিকারের ভাষায় কথা বলেছেন এবং এমন অধিকার তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) কেও দিয়েছেন।
এই সূত্র ধরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওসাল্লাম) বলেনঃ
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ البخاري (15) ، ومسلم (44)
তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ আমি তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয় না হতে পারব তাঁর বাবা-মার চেয়ে, ছেলে-মেয়ের চেয়ে ও সকল মানুষের চেয়ে। (বুখারী ১৫, মুসলিমঃ ৪৪)।
আবু সুফিয়ান (রাঃ) ইসলাম গ্রহনের আগেই অবাক হয়ে বলেছিলেন যে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের) অনুসারীরা তাঁকে যত ভালোবাসেন এমন ভালোবাসা আমি আর কোন নেতাকে করতে দেখিনি।
সাহাবীরা আমাদের প্রিয়তম নাবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওসাল্লাম) কে কত গভীর ভালোবাসতেন তাঁর অসংখ্যা ঘটনা ও গল্প ইতিহাস ও সীরাতের পাতায় ছড়িয়ে আছে। আবু বকর (রাঃ) সহ আরো অনেকেই তাঁকে ছায়ার মত ঘিরে রাখতেন। তাঁর নিরাপত্তায় তাদের নিজের জীবনকেও বাজি রেখে পাশে থাকতেন।
ইমাম তাবারানী বর্ণ্না করেছেন আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে- অহুদের দিন মদীনা বাসীর মধ্যে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়লো- মদীনার এক আনসারী মহিলা পাগলপরা হয়ে যান এই খবর শুনে। তিনি ছুটে চলেন অহদের দিকে? যখন তাঁকে বলা হলো- আপনার স্বামী, ভাই ও সন্তানেরা শহীদ হয়ে গিয়েছেন। তিনি বারবার জানতে চান আমার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) কেমন আছেন সেটা বলুন। যখন তিনি নিজ চোখে দেখলেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাহু আলায়হি ওসাল্লাম) জীবিত আছেন তখন তিনি বললেন- আমার বাবা-মা আপনার জন্যে কোরবান হোক, আপনি নিরাপদ থাকলে অন্য কোন বিপদ আমার কাছে আর কিছুই নয়।
মহিলারা স্বাভাবিকভাবেই আবেগী হন তাদের সন্তানদের প্রতি এবং বাবার প্রতি। যুদ্ধে বাবা, ভাই, স্বামী ও ছেলে মারা যাওয়ার খবরেও একটু বিচলিত হলেন না যেমন বিচলিত হয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের ইন্তেকালের সংবাদে। এটার নাম প্রকৃত ভালোবাসা। এটাই হলো ইমানের স্বাদ ও দাবী।
আমরা তো আর আমাদের প্রাণের নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইয়হি ওসাল্লাম) কে দৈহিকভাবে সরাসরি দেখি নি। ফলে, তাঁকে রক্ষা করার জন্যে আমাদের জীবন উতসর্গ করার সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া দ্বীন ও সুন্নাতকে রক্ষা করার জন্যে আমাদের জীবনকে ঝুকি ও বাজি রাখার দাবী ও সুযোগ আছে। এর প্রথম কাজ হলো কষ্ট হলেও তাঁর সুন্নাতের পাবন্দী হওয়া। মনের আকুতি ও আবেগ মিশিয়ে তাঁর সুন্নাতকে লালন করা ও প্রচার করাই হলো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওসাল্লাম) কে রক্ষা করা।
যিনি যত বেশী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম)কে ভালোবাসবেন, তিনি হবেন সুন্নাতের ততবেশী পাবন্দী ও অনুসারী। লোক দেখানোর জন্যে নয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওসাল্লাম) কে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) সহ অনেক সাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের উম্মতের বড় বড় উলামায়ে কেরাম সুন্নাতের এতো বেশী অনসুরণ করতেন যে তারা মনে হতো সুন্নাত জানা ও মানার জন্যে পাগল থাকতেন।
সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই প্রতিযোগিতা করতেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) এর ভালোবাসায় প্রতিযোগিতা করতে। এবং কে কত তাঁর প্রিয় সেটা নিয়েও তারা আলোচনা করতেন। এবং এজন্যে তারা জীবনের সবকিছু বা অনেক বড় কোরবানী করার জন্যে প্রস্তুত থাকতেন।
আচ্ছা, মনে করুন আমরা এখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) ও তাঁর ভালোবাসা নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা বিশ্বাস করি- আমরা তাঁকে ভালোবাসি। আমরা যদি তাঁর সামনে উপস্থিত থাকতাম আর তিনি আমাদেরকে কিছু আদেশ করতেন বা বলতেন, তাহলে কি আমরা তা উপেক্ষা করতে পারতাম? অবশ্যই না। যদি তাই হয়, তাহলে বলব- আমাদের সামনে কিতাবে তাঁর অনেক আদেশ ও বাণী আছে। ভালোবাসার দাবী হলো- আমরা প্রথমে তাঁর সুন্নাতগুলোকে জানার চেষ্টা করব। আমরা তাঁর জীবনের ইতিহাস, ঘটনা ও কাহিনী- যাকে আমরা বলি সীরাত জানার চেষ্টা করতে হবে। তিনি কিভাবে জীবন যাপন করতেন এবং চলতেন এগুলো জানতে হবে।
যাকে ভালোবাসি- তাঁকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি- এখন কোথায়? কি করছেন? নাস্তা করেছেন? ঘুম হয়েছে? আরো কত প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। কারণ আমি তাঁকে ভালোবাসি। তাই, আমিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) এর জীবনের বিভিন্ন দিক জানার চেষ্টা করি বা করতে হবে কারণ আমিও তাঁকে ভালোবাসি, শুধু ভালই বাসি না, আমিত তাঁকে আমার মনের যত আবেগ আছে, সম্মান আছে, সমীহ আছে, বিবেক আছে- সব দিয়েই ভালোবাসি। আসলে, উনাকে যত জানি, ততই ভালো লাগে। মনে হয় তাঁর বাইরে যত সুন্দর, তাঁর ভেতরটা তো আরো অনেক অনেক সুন্দর।
তাঁর সীরাত পড়তে পড়তে মনে হয়- আমার প্রিয়তম নবী ছিলেন খুবই মায়াবী ও দয়ালু মানুষ। আমার এই দুই চোখে তাঁকে সরাসরি কোন দেখিনি। কিন্তু মনে হয় তিনি তো আমার কত দিনের পরিচিত- একেবারেই একজন আপন মানুষ, যিনিও আমাকে ভালোবাসেন। আমি আসলে এমন কেউ নই, নই এমন কিছু যে তাঁর মত এক মহান মানুষ আমাকে ভালোবাসতে যাবেন। কিন্তু দেখেন- কি তাঁর মহত্ব ও দয়া। বয়েসে যেমন আমি তাঁর শত শত বছর ছোট, জ্ঞানে তো আকাশ-পাতাল তফাত, যোগ্যতার তাঁর সাথে আমার কোন তুলনাই নেই, বংশে তিনি কুরাঈশ আর আমি ভারতীয় কোন মফস্বলের ছেলে। অথচ আমি যখন মন ভরে বলি- আসসালাতু আস-সালামু আলায়কা ইয়া রাসূলুলাল্লাহ তখন মনে হয় তিনিও যেন হৃদয় কাড়া এক মিষ্টি হাসি দিয়ে তিনিও বলছেন- অয়ালাইকুমুসসালাম, ইয়া আবাল কালাম !!
তাঁর কন্ঠে কি এক মায়াবী টান। আহ, তা শুনে আমার কান-মন জুড়িয়ে যায় সে মধুর টানে।
আমি কল্পণা করি-
আমার এই ধুসর হাতটা বাড়িয়ে দিলাম উনার পানে। আর কি পরম স্নেহে তিনিও তাঁর সেই তুলতুলে নরম হাত দিয়ে ভরে দিলেন আমার হাতকে। এমন কোমল হাত তো আমি কোনদিন দেখি নি!! কোমল স্নেহভরা মিষ্টি স্পর্শে আমি যেন হারিয়ে গেলাম অন্য এক জগতে। উনি যখন আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন, তখন মনে হচ্ছিলো- আহহ, আমি যদি সারাজীবন তাঁর এই ভালোবাসার করকমলে বাধিত হয়ে থাকতে পারতাম !! তাঁর মনটা ছিলো মানুষের জন্যে, চারপাশের পশু-পাখি, গাছ-গাছালি- সবার জন্যে এক বিশাল করুণা।
কিন্তু আমার অনেক ভয়ও লাগে। যিনি আমাকে ভালোবাসেন, আমি কি তাঁর কথা শুনি? সব শুনি? সব সময় শুনি? পুরাপুরি শুনি? দেখুন তো সাহাবারা তাঁর কথা কত নিখুত ভাবে শুনতেন। একবার বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) এর কাছে এলেন, তখন তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি তখন মসজিদের বাইরে। ইবনে রাওয়াহা শুনলেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওসাল্লাম) বলছেন- ইজলিসু- তোমরা বস। এ কথা শুনে ইবনে রাওয়াহা তখনই বাইরে বসে পড়লেন। তিনি সে অবস্থায় বসেই রইলেন। বয়ান শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামে) র কাছে যখন এই ঘটনা বলা হলো তখন তিনি বললেন- «زادك الله حرصاً على طواعية الله وطواعية رسوله». (الإصابة: 2/306).
এই ঘটনা বলা অর্থাৎ আল্লাহ তোমার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্যের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিন।
আল্লাহু আকবর। তাঁরা আমার প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) কে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন যে তিনি যা বলতেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতেন। তাঁরা তো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) তাদের সব কিছু দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু আমি তো মনে হয় মুখেই দাবী করি বেশী। কিন্তু প্রয়োজন ছিলো ভালোবাসার দাবীটা কাজে বা আমল করে দেখানো।
আল্লাহ যেন আমাকে এবং আমার মত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) কে ভালোবাসেন তাদেরকে মন ভরে তাঁর কথা মত চলার তৌফিক দিন। আমীন।