ডঃ সালাম, খুব ভালো একটা বিষয় আপনি আলোচনা করেছেন, তবে আপনি আমার মত মনোবিজ্ঞানী হলে আপনার আলোচনায় আপনিই বেশি খুশি হতেন।
আমি বললাম, কেন?
ডঃ আমের একজন নামকরা ইরাকী চিকিৎসক। তিনি বললেনঃ ‘আমি এই আয়াতটা কতদিন কতবার পড়েছি ইয়ত্তা নেই। অথচ আপনার আলোচনা থেকে মনে বল পেলাম, আল্লাহ আমাদের এমনি এমনি ছেড়ে দেন নি। তিনি সবকিছুই আমাদের দিয়েছেন’।
আমি আরো ঔৎসুক্য দেখালাম।
তিনি বললেনঃ “আপনার আলোচনা ছিলো মুহসিনীনদের সংজ্ঞা সম্পর্কে”। আমি মাথা কাৎ করে হাঁ সূচক ইংগিত করলাম। আল্লাহ বলেছেনঃ যারা সুখে দুঃখে, স্বচ্ছলতায় অস্বচ্ছলতায় ব্যয় করে, রাগ হলে খুব কষ্ট করে হলেও হজম করে, মানুষকে ক্ষমা করে, আল্লাহ এই সব মুহসিনদের ভালোবাসেন। আলইমরাণ, ১৩৪।
দেখেন আমরা যখন মনোঃরোগীর চিকিৎসা করি তাদের বলি, “তোমরা মানুষকে ক্ষমা করতে শেখ”। কারণ বিশ্বে মনোরোগের প্রধানতম কারণের মধ্যে দেখানো হয় অতি রাগ। কারণ মানুষের উপর রাগলে ভাষায় গরল মেশে, দৈহিক আচরণে পাশবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে, ও ব্রেইনের চাপে মানবিক আচরণ মারাত্মক ভাবে বিকৃত হয়। এই সময় যদি সে ক্ষমা করতে শেখে, এবং রাগ হজম করতে পারে, তাহলে তার হার্ট ও ব্রেইন খুব শান্ত হয় এবং মারাত্মক হার্ট রোগ, কিংবা শারীরিক বৈকল্য থেকে রক্ষা পায়।
আমি ডঃ আমেরের দিকে তাকায়ে থাকলাম। ইফতার খাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেছে তার সুন্দর আলোচনায়। মুগ্ধ হচ্ছি আমি।
তিনি বললেনঃ ‘মানুষকে না ক্ষমা করলে, শক্তি থাকলে আপনি প্রতিশোধ নেবেন। এতে আপনার মারাত্মক হৃদরোগ হয়ে যেতে পারে। কারণ প্রতিশোধ স্পৃহা শরীর, মন, পরিবার ও সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যে প্রতিশোধ নেয়, এবং যার উপর থেকে পরতিশোধ নেয়া হয় তারা দীর্ঘ শত্রুতায় অবতীর্ণ হয়। ফলে সমাজে টেনশান বিরাজ করে। এবং তা দীর্ঘদিন, এমন কি সারাজীবন, অথবা বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। চায়নীজ একটা প্রবাদ এই রকম, “প্রতিশোধ নিতে চাইলে নিজ হাতে দুইটা কবর খুড়বে। একটা তোমার শত্রুর জন্য, আরেকটা তোমার জন্য”।
‘আর যদি তুমি দূর্বল কিসিমের হও, এবং প্রতিশোধ না নাও, অথচ ক্ষমাও করলেনা। তাহলে আরো বিপদ হবে তোমার। ঐ লোকটাকে দেখলে তোমার মন মেজাজ বিগড়ে যাবে। তোমার পরিবারে তার বিরূদ্ধে পরচর্চা হবে। তোমার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে ঐ লোক সম্পর্কে মারত্মক ভাবে শত্রুতা ও গীবৎ হবে। এখন তোমার কিছু শত্রুরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তোমাদের মাঝে এমন ভাবে চোগলখুরী শুরু করবে যে তোমার রাতের ঘুম ও দিনের আনন্দ একদম হারাম হয়ে যাবে।
তুমি রাগ হজম করে তাকে ক্ষমা করে দিলে তুমি যদি সঠিকও হয়ে থাকো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করবেন। কারণ তোমার উপর একজন জুলুম করলেও তুমি তাকে ক্ষমা করেছো এর মানে তুমি আল্লাহর গুণ ধারণ করলে। ফলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর তুমি যে ভুল করোনি এটা আল্লাহ তার মাথায় একদিন ঢুকায়ে দেবেন। তোমার আচরণে সে একদিন এমন খুশি হয়ে যাবে যে, যে শত্রুতা তোমার সাথে ছিলো তা পানি হয়ে তোমাদের দুজনের মাঝে আল্লাহ গভীরতম বন্ধুত্ব তৈরি করে দেবেন। ‘ফাইযাল্লাযী বায়নাকা ও বায়নাহু ‘আদাওয়াতুন কাআন্নাহু ওয়ালিয়্যুন হামীম’। তোমার ও তার মধ্যে যে আদাওয়াত ছিলো, শত্রুতা ছিলো তা উষ্ণ বন্ধুতায় পরিবর্তিত হয়ে যায়’।
ডঃ আজাদী, গত সপ্তাহে আপনি যখন বললেনঃ সূরা আলইমরাণের ১৩৩ থেকে ১৩৯ আয়াত গুলো মনোরোগের চিকিৎসা, তা শুনে বাসায় এসে আরো স্টাডী করে অদ্ভুত এক জগতের সন্ধান পেয়েছি’।
আমি তাকায়ে থাকলাম। বললাম, ডঃ আমের, আপনি আমার আলোচনা শুনেছেন এইজন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে আমার ব্যাখ্যার সাথে আপনার ব্যাখ্যা যোগ করে তো আমার মনে হচ্ছে সারা জীবন আল্লাহর জন্যে সাজদাহ দিয়ে পড়ে থাকি।
তিনি বললেনঃ ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহ কত মহান, তিনি আমাদের নবী (স)কে পরামর্শ দিচ্ছেন, আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং মার্জনা করুন। আল্লাহ ‘মুহসিন’দের ভালোবাসেন’।
আমি বল্লামঃ “ডঃ আমের এই যে আফউন শব্দের প্রয়োগ হলো, মানে এমন ভাবে ক্ষমা করা যাতে ঐ লোকের থেকে পাওয়া কষ্টের কোন ছাপ ও তোমার অন্তরে না থাকে। আর “ওয়াসফাহ” বলে বুঝানো হচ্ছে, ঐ লোকটার সাথে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় বা নতুন পাতা শুরু করো। আগের গুলো সব ভুলে যাও”।
ডঃ আমের বললেনঃ সুবহানাল্লাহ, কুরআন দেখি মনোরোগের চিকিৎসার খুব উচ্চমার্গের বই।
বলে উঠলামঃ “আলবৎ, আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনুসের ৫৭ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ “হে মানুষেরা তোমাদের কাছে তোমাদের রবের কাছ থেকে উপদেশ এসেছে, অন্তরে বাসা বাঁধা রোগের উপশম হয়ে এসেছে, মুমিনদের জন্য হিদায়েত ও রহমাহ রূপে নাযিল হয়েছে”।