কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ আজ পর্যন্ত যতজন কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন, তারা কেও একটা সংজ্ঞায় একমত হননি। এর দ্বারা তারা বুঝিয়েছেন কবিতা জিনিষটা কোন সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করা যায়না। তবে শব্দ থাকে এখানের সেরা পুঁজি, শব্দের সংযোজন থাকে এখানে কারেন্টের নেগেটিভ পজেটিভ, শব্দের বুনন বা গাঁথুনি থাকে এখানে কবির আরাধ্য, এবং বুঝানোর দূর্বোধ্যতা থাকে এখানের হেঁয়ালি বা কবির শয়তানি। “শয়তানি” বলেছি বলে আবার মন খারাপ করবেন না। আমাদের পূর্ববর্তি আরবী ও ইসলামি সাহিত্য সামলোচকগণ এই “শয়তানী” শব্দটা বেশ প্রগলভতার সাথে উচ্চারণ করে গেছেন।
শব্দ নিয়েই কবিতার খেলা শুরু হয়। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডঃ আব্দুল বাসিত বদর “শব্দ” সম্পর্কে আমাদের পড়াতে যেয়ে দুইটা বিষয় বলেছিলেন। একটা হলো শব্দের গন্ধ। আরেকটা হলো শব্দের তাপ।
শব্দের গন্ধ আছে। তা শুঁকতে হয়। কবিরা তাই যে কোন শব্দকে যে কোন স্থানে বসাতে চায়না। যার গন্ধের সাথে যার শরীর মানায় তাকে সেখানেই বসায়ে থাকেন। ভালোবাসার কাতরতায় শব্দের সুমিষ্টতা যেমন কাম্য, রিক্তের বেদনায় অশ্রুর বাষ্পময় শব্দের তেমন অত্যন্ত দরকার। তবে স্থূলতাময় মারত্মক “সরলতা” কবিতায় আসেনা। আসে অধরা, অসপর্শ বা আসীম অর্থের ঝিলিক নিয়ে আসা নরম কোমল পুষ্পিত শব্দের সলীলময় অক্ষরের ব্যাঞ্জন।
আপনি সূরা রহমানের প্রথম ফাবি আয়্যি আলা পর্যন্ত পড়েন। দেখেবেন শব্দগুলোর অক্ষরেরা “শাদীদ” (শক্ত) বর্ণের চেয়ে “রিখওয়া” (কোমল) বা “তাওয়াসসুতের” (মধ্যম) পর্যায়ের বেশি। কিন্তু সেই একই সূরার ৩৭, ৩৯, ৪১ আয়াত ৩টা পড়েন, দেখবেন শব্দ গুলো যেন হাতুড়ি দিয়ে আপনার অন্তরে পেটাচ্ছে। কারণ তা কিয়ামতে সংঘটনের সময়ের কথা। তাতে অপরাধীদের পাকড়াও করার করার কথা আছে।
জুলায়খার নোংরামির সময়ের শব্দটা ছিলো যৌনময় গোংরামী। “হায়তা লাক”। এই সময়ে পরিপূর্ণ শব্দ উচ্চারণকরা মেয়েদের সম্ভব হয়না। কারণ রুমের সমস্ত দিকের দরোযা বন্ধ করে দিয়ে আরাধ্য যুবককে হাতের নাগালে পেলে তাদের বুক ফাটে, কিন্তু মুখ ফোটেনা। কাজেই “হাইয়া’তু নাফসী লাক” (আমি তোমার জন্য প্রস্তুত) কথাটা বলার সময় কই। আল্লাহ তাই জুলায়খার ভাঙা ভাঙা স্বরের সংক্ষেপিত “হায়তা লাক” শব্দটাকে তুলে ধরেছেন। সে সময়য়ে জুলায়খার মনোদৈহিক, বা পারিপার্শিক অবস্থার বর্ণনা দিতে সঠিক শব্দটাই আনা হয়েছে এখানে।
কবিও এইভাবে শব্দ শুঁকে থাকেন। কোনটার কি গন্ধ তা বুঝার চেষ্টা করেন।
আবার ইউসুফ (আ) এর নৈতিক উঁচুতার কাছে পরাভুত পার্থিব শব্দের পরিবর্তে অপার্থিব শব্দের ব্যবহার আমাদেরকে শব্দ ব্যবহারের এক স্বপ্নময়তার কাছে নিয়ে যায়। “মাআয আল্লাহ” বা আল্লাহর আশ্রয় বলে আল্লাহ আমাদের এক অশরীরী স্পর্শ অথচ অত্যন্ত শক্তিশালী এক সত্ত্বার স্নেহময় কোলে নিয়ে আসে। ইউসুফের ঐ শব্দ দুটো ছিলো ছুটে চলার প্রণোদনা, ঐখানে ছিলো আশ্রয় পাওয়ার যাচনা হেতু ভিখারির ভাষা, ছিলো পবিত্রতা অর্জনের জন্য শুচি শুদ্ধতার দিকে প্রাণান্ত পলায়নের এক জান্নাতি স্বপ্নের প্রতিনিধিত্বকারী শব্দের সম্ভার। “মাআয আল্লাহ”।
ঈমানদার সাহিত্যিক শব্দ শুঁকতে নাকের তিনটি ছিদ্র বানায়। একটা হলো বিশ্বসাহিত্যের উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট শব্দ শুঁকার জন্য একটি। ঈমানী শব্দের গন্ধ বোঝার ছিদ্র ও কুফরি বা শিরকি শব্দ বুঝার মতো আরেকটি ছিদ্র। প্রথমটির জন্য তাকে অনেক পড়তে হয়। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির জন্য তাকে অনেক শিখতে হয়। আমি আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইসলামী সাহিত্যিকগণের মাঝে দ্বিতীয়গুণটা খুব কমের মধ্যে পেয়েছি। তবে কবি নজরুল এবং ফররুখের মধ্যে ঈমানী ও কুফরী শব্দের ব্যাপক জ্ঞান লক্ষ্য করেছি।
মুহাম্মাদ বিন আহমাদ ইবন তাবাতিবা তার “ইয়ার আল শি’র” এর (পৃ ৫-৬) মধ্যে বলেন, প্রতিটি শব্দের একটা উদ্দিষ্ট ভাব আছে। এই ভাবের সাথে ভাব প্রকাশকারীর মননে প্রোথিত বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকে। কাজেই কবি সাহিত্যিক যখন কোন ইসলামি ভাব প্রকাশ করতে চায়, তখনই সাহায্য গ্রহন করে ঐ সব ভাব বহনকারী শব্দ ভান্ডারের। এভাবেই তার ইসলামি ভাব প্রকাশের উপযুক্ত পাত্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ে শব্দ গুলো। আর সেই গ্রথিত শব্দগুলো তৈরি করে ভাষা।
শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নবী (সা) অনেক রকমের শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, (৫৮২৫) মহানবী (সা) বলেছেন, তোমাদের কেও যেন না বলে “আমার অন্তর পুঁতিময় (খবীস) হয়ে গেছে, বরং বলবে আমার মন শক্ত (লাক্বিসাত) হয়ে গেছে”। দেখেন শব্দ শুঁকে ব্যবহার করা জন্য এর চেয়ে আর কি দলীল লাগবে। একজন লোক আমাদের নবী (সা) এর সামনে বললোঃ “আল্লাহ চেয়েছেন আর আপনি চেয়েছেন”। এ কথা শুনে তিনি বললেনঃ না, এই কথা তোমরা বলোনা। বলবেঃ “আল্লাহ চেয়েছেন, অতঃপর (সুম্মা) আপনি চেয়েছেন”। “ওয়াও” এবং “সুম্মা” এর ব্যবহার একটা বাক্যকে শিরকি বানায় অন্যটিকে ঈমানী বানায়।
এই দিকেই লক্ষ্য করে আমাদের নবী (সা) মানুষের নাম পরিবর্তন করে দিতেন। সাঈদ ইবন আলমুসায়্যিব ইবন আলহাযন বলেন আমার দাদা নবী (সা) এর কাছে এলে তিনি নাম জিজ্ঞেস করেন। আমার দাদা জবাব দেন “হাযন” (শক্ত মাটি)। নবী (সা) বললেন না, তুমি সাহাল, (নরম মাটির সমতল ভূমি)। (বুখারী, কিতাবুল আদাব)।
শব্দের গতরে ইসলামি পোশাক পরাবার আরেকটা ভালো উপায় হলো তার উপর সুন্দর গন্ধের আতর ছড়াতে হয়। দেখেন স্ত্রীর সাথে বৈধ মিলনের যে যৌনবিজ্ঞানীয় নাম আছে তা কুরআন একটা বায়বীয় অথচ সুন্দর শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেছে। সূরা বাক্বারার ২২৩ শষ্যক্ষেত্রের কাছে আসা, নিসার ২১ একে অপরের সান্নিধ্যে আসা, নিসার ৩৪ ঘুমানোর যায়গায় ত্যাগ করো, এবং ঐ একই সূরার ৪৩ নম্বর আয়াতে মেয়েদের সাথে পরস্পর স্পর্শ করো বলে দেখুন কি সুন্দর ও পবিত্র শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলা ভাষার শব্দগুলোর মা হলো শিরকবাহী সংস্কৃত ভাষা। সেখান থেকে মুসলিম কবি সাহিত্যিকগণ অনেক খেটেছেন এই ভাষাটাকে ইসলামি করণে। আমি যখন এই ভাষার প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের সাহিত্যিকগণকে পড়ি, তখন মন ভরে যায়। তাদেরকে এই আধুনিক মুসলিম ভাষা তৈরি করতে রীতি মত যুদ্ধ করতে হয়েছে। যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি গালাগালি সহ্য করতে হয়েছে তাদের।
আমার শায়খ ইমাম আবুল হাসান নাদাওয়ী একবার ঢাকায় এসেছিলেন। আমি তখন তামিরুল মিল্লাতের ছাত্র। ইসলামিক ফাউন্ডেশানে তিনি এসে একটা তাক্বরীর পেশ করেন। সেখানে তিনি আফসোস করে দুইটা কথা বলেছিলেন। দুইটাই আমার চোখ খুলে দেয়। এবং পরবর্তিতে তার ই আলোকে আমি মাস্টার্সের থিসিস লিখি। তিনি বলেছিলেন ঊপমহাদেশের মুসলিমগণ দু’টো ভাষার জন্ম দাতা। এক ঊর্দূ। যা আজো মুসলিমদের হাতে থাকায় উৎকর্ষে শীর্ষ। আরকেটা হলো বাংলাভাষা, যা আধুনিক কালে পৌত্তলিকদের হাতে চলে গিয়েছে। মুসলিমগণ বিশেষ করে উলামায়ে কিরাম তাকে কোলে না নেয়ায় তা থেকে ইসলামি রং ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসার ক্লাসগুলো উর্দু ভাষায় নেয়াকে খুব অপছন্দ করেন। তিনি নির্দেশ দিয়ে যান এই সব মাদ্রাসা গুলোতে যেন মাতৃভাষার চর্চা হয়।
আমি তাজ্জব হয়ে যাই যখন একজন ঈমানদার ব্যক্তি অবলীলায় ব্যবহার করে যাচ্ছে নানা রকম শিরক ও কুফরী মূলক শব্দ। আমাদের জহুরী (সালাহুদ্দীন) এ সম্পর্কে শব্দ সংস্কৃতির ছোবল বইতে কিছু শব্দের আলোচনা করেছেন। যেমনঃ আমরা প্রায় ই এই শব্দগুলো ব্যবহার করিঃ আলিঙ্গন, ঐশীবাণী/ঐশীশক্তি, কীর্তন, তিলোত্তমা, দৈববাণী, প্রয়াত, বেদী, বিশ্ব ব্রম্মাণ্ড, লক্ষ্মী, সতী সাধ্বী, স্নাতক, হরিলুট ইত্যাদি। আমরা এই শব্দ গুলো যে ব্যবহার করা ঠিকনা তাও জানিনা। কাজেই ভাষার গায়ে ইসলামি পোশাক পরাতে হলে আমাদের ঐ সব শব্দ পরিহার করতে হবে যা আমাদের ঈমানে আঘাত করে, বা কুফরির সাথে মিশিয়ে দেয়।
শব্দে ইসলামি রঙের ঢেও খেলাতে আমাদের শব্দের “তাপ” বিভিন্ন ভাবে মেপে দেখতে হয়। ইমাম আবুল হাসান নাদাওয়ী ছিলেন এই ব্যাপারে বড় ধরণের থিউরীদাতা। ডঃ আব্দুল বাসেত বদর আমাদের যখন এই বিষয়টা পড়ান তখন আমি এটা নিয়ে ভাবতে থাকি। পরে ইমাম নাদাওয়ীর লেখা গুলো পড়ে আমি অভিভূত হয়ে যাই। তিনি এ সম্পর্কে যে সব কথা বলেছেন তা আমি একটা বইতে প্রকাশ করেছি। এটা মিশরের দারুল মানারাহ থেকে একাধিক এডিশনে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি বলেন, “শব্দ সম্ভার ও তার গাঁথুনি ছাড়া কোন ভাষা কল্পনা করা যায়না (আল মাদখাল ইলা আদ দিরাসাত আল কুরআনিয়্যাহ, ১৩)। আর এই শব্দ সম্ভার ও তার গাঁথুনিই মূলত আমাদের চিন্তা ও কল্পনা প্রকাশে মারত্মক ভূমিকা পালন করে। যদি এই শব্দ গুলো মন থেকে সলীল প্রবাহের মত বের হয়, যেখানে থাকবেনা সাহিত্যশক্তি প্রকাশের ভণিতা, অথবা অহংকার, শব্দের গতি যদি থাকে সহজতার পথে ধাবমান, বোঝার ক্ষেত্রে যদি তা হয় সরল সোজা, তা হলে তা মানব মনে দারুন প্রভাব ফেলে। তিনি তাই ভাষা নির্মানে যে শব্দের জয়গান গেয়েছেন তা হলোঃ বেছে বেছে নেয়া অপংকিল শব্দ, হালকা হালকা শব্দের বুননে এমন প্রকাশ যাতে থাকে সূক্ষ্মতার স্বাদ, ও কোমলতার স্পর্শ। যদি শব্দগুলো কোন কবি বা সাহিত্যিকের কলিজার টুকরা হয়ে আসে, অন্তর দীর্ন হয়ে বের হয়, কিংবা অশ্রুর দমকে তার উছলে পড়ে সাহিত্যে – তা হয় সাহিত্যের একেকটা মুজিযা, এবং তা হয়ে ওঠে কালান্তর। মনে মনে তার প্রতিধ্বনি হয়, মুখে মুখে তা গীত হয়, কানে কানে তা হয় নিত্য শ্রুত। (নাযরাত ফীল আদাব, ২৮)।
তিনি বলেছেন শব্দের তাপ আছে। এই তাপ তুমি বুঝে নাও, (শাখসিয়্যাত ওয়া কুতুব, ৭)। যেখানে আগুনের হল্কা বেয়ে যাবে তার জন্য নিয়ে এসো ফুল্কির ধারা। বিদ্রোহের যায়গায় আনো ঘোড়াদের অনিরুদ্ধ দুল্কির সাওয়ার। প্রেমের বাগানো আনো পুষ্পকোমল সুরভী। আর বেদনার বুক জ্বালায় নিয়ে এসো আঁসুময় ঢেও। তোমার পাঠক যেন তোমার সাথে হাসে, তোমার শব্দে কাঁদে, তোমার ভাবনায় মিশে যেয়ে সমূদ্রের গভীরে হারাতে তোমার হাতে হাত রাখে।
এখানে কুরআন আমাদের দেখায় নতূন নতূন দিগন্ত। অপরাধী কে বেঁধে আনতে আল্লাহর যে নির্দেশ আলোচনা করা হয়েছে তা একটু পড়ে দেখুন। অক্ষর গুলোর কাঠিন্য, শব্দ গুলোর মারাত্মক অমসৃনতা, এবং স্বরগুলোর বিপজ্জনক ঝঙ্কার আপনাকে ভীত, কম্পিত এবং বেদনার্ত করে তুলবে। আপনি না বুঝেলেও কারো তিলাওয়াত শুনুন দেখবেন ভয় পাচ্ছেন।
خُذُوهُ فَغُلُّوهُ (30) ثُمَّ الْجَحِيمَ صَلُّوهُ (31) ثُمَّ فِي سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُونَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوهُ (32)
ধর একে, গলায় বেড়ি পড়িয়ে দাও, তার ঢুকায়ে দাও জাহীমে। অতঃপর তাকে বেঁধে ফেলো সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। (সূরা হাক্কাহ, ৩০-৩২)
এর ই আলোকে আপনি এখন পড়ে যান বিশ্ব সাহিত্য, রচনা করেন আপনার সেরা সাহিত্যের নমূনা, দেখবেন তা কেমন মোহময় হয়ে ওঠে।
আব্দুল মান্নান সৈয়দ স্যারের সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। তিনি অনেক ভালো ভালো কিছু কথা আমাকে শিখিয়েছেন। তার মধ্যে একটা হলো, কেন নজরুলের লেখায় এমন বিদ্রোহের ঝংকার এবং কেন রবীন্দ্রনাথের লেখায় এত মিনমিনে সুর। তিনি বলেছিলেন, নজরুলের তাওহিদী চেতনা দুনিয়ায় আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত করায়নি। পাহাড় দেখে মাথা নত তো হয়নি তার, বরং তা ডিঙিয়ে অথবা এই বিন্ধাচল মাড়িয়ে অথবা ভেঙে সামনে যেতে চেয়েছেন। তিনি বন্দীত্বকে কে ভেঙে লোপাট করতে চেয়ছেন, তিনি আকাশে উত্থিত হতে চেয়েছেন। অথচ রবীন্দ্র নাথের মাথা নত হয়েছে সর্বত্র, মিনতির গান সারা স্বরলীপিতে, এবং আত্মসমার্পন কখনো সৌন্দর্যে, কখনো বৈভবে, কখনও সমাজের শীর্ষে যাবার লিপ্সায়। ফররুখের কবিতা গুলোতে দ্রোহের গান আসেনি, এসেছে কালো অমানিশায় পথ খুঁজে পাওয়ার প্রেরণা, প্রণোদনা। এ জন্য কখনো ক্ষেদ, কখনো জাগরণী আহবান, কখনো আত্মসমালোচনা বা কখনও দূর্বলতার অঙ্গুলি নির্দেশ।
আরেকটা কথা এখানে আলচনা করা দরকার। তা হলো কবিতার ভাষা কিন্তু কখনো আইনের ভাষা নয়। কুরআনে আমরা মাদানী ও মাক্কী সূরার ভাষায় অনেক পার্থক্য দেখি। মাদানী যুগের সূরায় আনা হয় হুকুম আহকাম, যেখানে আইনি ভাষার প্রাবল্য। অথচ মাক্কী জীবনের সূরা গুলোতে পাবেন দুনিয়ার সেরা কবিদেরকে মূক করে দেয়া কুরআনি মুজিযাহ।
সোজা সরল কথা আপনি বলতে পারেন স্টেইজে উঠে। বলেন মিম্বরে দাঁড়িয়ে। বলেন বাচ্চাদের নানান নির্দেশ দিতে।
কিন্তু আপনি যখন আবেগ নাড়া দেবেন, ভালোবাসার উৎসার ঘটাবেন, দ্রোহের গান শোনাবেন, প্রেমের মালা পরাবেন, বিরহের ফুল ফোটাবেন সেখানে আপনি অতো সোজা কেন? কুহেলিকা তৈরি করুন, কুজ্ঝটিকার আস্তরণের আপনার ভাষার সূর্যকে ঢেকে ফেলুন, এবং হেঁয়ালিতে ভরে দিন আপনার মূল কথা গুলো।
আপনার শব্দরা নানান রঙ ধরুক, নানান অর্থের পথ দেখাক, সন্দিহান করে তুলুন পাঠককে। কখনো সে ভাবুক আপনার মত করে, কখনো সে বুঝুক তার নিজের মত করে, কখনো আপনার শব্দরা হোক আপনার যুগের প্রতিভু, আবার কখনো ঐগুলো হোক আগামি এক শত বছর পর আসা পাঠকের যুগের উপযুক্ত। এখানে কবিরা খুব ‘খেলা পাগল’। ওরা শব্দ নিয়ে খেলে। তা হয় নানা কৃত ও তদ্ধিত প্রতয়ে সংযুক্ত, নানা সমাসের দ্বারে ঢোকা আগন্তুক, কিংবা নানা প্রকার কারকের রসে জারিত। তারা নিজের মত করে তৈরি করে উপমা, আনে উৎপ্রেক্ষা, বানায় রূপকল্পতা। ঝংকারে আনে নানা সিম্ফন। কেও কেও কী শক্তিমান হয়, কালোত্তীর্ণ হয়, নিজ জাতির মাঝে থেকে উপরে অন্য জাতির মাঝে সাঞ্চারিত হয়, জিওগ্রাফির সীমা ছিন্ন ভিন্ন করে বিশ্ব সভায় যায়গা নেয়।
একে আগেকার মুসলিম সাহিত্য সমালোচকগণ “শায়তানাতুশ শি’র” বা কবিতার শয়তান বলেছে। শয়তান বলার কারণ এর প্রভাব এক মারাত্মক ভাবে মানুষের মধ্যে পাড়ে। আমাদের নবী (সা) অবশ্য এটাকে ‘যাদু’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইন্না মিনাল বায়ানি লাসিহরা। (বুখারী, ৫৭৬৭)। অর্থাৎ কিছু কিছু বলার ভংগিমায় আছে যাদু। তিনি এইটাকে যাদু বলেছেন। কারণ এই ধরণের সাহিত্য অন্তর কেড়ে নেয়।