সকালে উঠলাম দেরিতে।ভাবছি আজকের প্লান নিয়ে। মসজিদে আজ মদীনার তাইয়্যিবাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আল-রাহওয়ান আসবেন। খুতবাহ দিবেন। তাকে রিসিভ করতে হবে এক গাল মুচকি হাসি দিয়ে। অনেক অনেক চুমা দিয়ে হায়্যাকাল্লাহ, আল্লাহ হায়্যিক বলতে হবে। এক কথা দুই তিন বার বলে আহলান সাহলান করে এক থেকে দেড় মিনিট পার করতে হবে। পরে টেবিলে বসে চা এগিয়ে দিয়ে বলতে হবে কায়ফা হালুকুম। কেমন আছেন?
বাসায় ঘুম থেকে উঠেই কেমন উষ্ণতার আমেজ। বড় মেয়ে আঠারো হলো আজ সকালে। তাকে বলতে হলো, “বাহ বাহ তুই ১৮ পর্যন্ত বাঁচলি। শোকর কর। আল্লাহ যেন তোর বাচ্চাকেও ১৮ বছর হয়েছে দেখার তৌফীক দেন”। কিন্তু এই সুন্দর দুয়া শুনে জানানো হলো এটা নাকি বার্থডে তে একটা “বিদআতী দুয়া”। আমি চেইঞ্জ করলাম, বললাম, “ আলহামদুলিল্লাহ। তুই আঠারো মানে এই দেশের নিয়ম অনুযায়ী তোর বিয়ে দিতে আমার আর বাঁধা নেই”। এই কথায় ও ধাক্কা খেলাম। বললো, “১৮ এর পর অনুমতি না নিয়ে তুমি আমাকে বিয়ে দিতে পারবানা”। মনে পড়লো আমার বড় ভাই ও বন্ধু মুফতী হুমায়ূন ভাইয়ের কথা। গত বছর তিনি আমার মেয়ের জন্য আমেরিকার এক ছেলের প্রস্তাব এনেছিলেন। ছেলেটা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। বললেন, “ভাইজান, মেয়ের উপর জোর থাকতেই বিয়ে দেন, নইলে খবর আছে। এরপরে আর জোর খাটবেনা”।
এই সব ঝামেলার মধ্যেই আসলো আরেক চিন্তা। লাফিয়ে উঠলাম। নাস্তা বানানো বাদ দিয়ে কম্প্যুটারের গতরে টেপাটেপি শুরু করলাম। কী যে হয় মাঝে মাঝে। প্রকৃতিক ডাক আমার চিন্তার রেশ লেখায় আনতে দিলোনা। পরে এসে নাস্তা খাওয়া, বৌ বাচ্চা হাঁকানো, গাড়িতে স্ট্যার্ট দেয়া, শায়খ কে কিভাবে আইন ও গাইন উচ্চারণ করে সম্ভাষণ করবো তার মহড়ায় আমার হৃদয় সরোবরে ভেসে ওঠা চিন্তাটা শেষমেশ মিশে গেলো হৃদয়ের তলে। বিশ্বাস করেন, ঐ বিষয়টা নিয়ে লিখলে কমপক্ষে এক হাজার লাইক পড়তে আজকে। কিন্তু চলে গেলো মনের গগন থেকে উধাও হয়ে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে
মসজিদে গেলাম। প্রফেসর সাহেব এলেন। শুভ্র জ্যোতি দেখলাম মুখের ভাঁজে, ঈমানের সুঘ্রান পেলাম জান্নাতি সালাম আদান প্রদানে, আর বিনয়ের মধু পেলাম আলিঙ্গনের উষ্ণতায়। আলহামদুলিল্লাহ। সাঊদীতে পাওয়া আলিমগণের এই একটা বড় গুণ, তাঁরা যত বড় হয়, বিনয়ের শাখা তাদের ততই অবনত হয়। শায়খ ইবন বায, শায়খ ইবন উছায়মীন, শায়খ আতিয়্যাহ সালিম, শায়খ আবু বকর আল জাযায়েরি, শায়খ বকর আবু যায়েদ রাহিমাহুমুল্লাহ – কত শায়খের নাম বলবো? এদের পাশে যেয়ে জান্নাতি বরাভয় যেমন পেয়েছি, পেয়েছি ঈমানি যিন্দেগীর সেরা গুণঃবিনয় ও সরলতা।
লাইব্রেরি রূমে বসলাম। কফি দিলাম। বিস্কুট খেলেন। পানিও হাতে নিলেন। এখানে খুতবার নিয়ম শুনলেন। ইংলিশে খুতবাহ হবে শুনে খুশি হলেন। কি কন্টেন্টে কথা বলা উচিৎ শুনতে চাইলেন। বললাম, শায়খ, “আপনার যা ইচ্ছা বলতে পারেন। কোন বাঁধা ধরা বিষয় নেই। শুধু মদীনাবাসীর (সা) ঈমানী জযবাহটা যেন কথার মধ্যে থাকে। তিনি স্তব্ধ হলেন। বললেন, ডঃ আজাদী, এই কথা তো কেও কোনদিন আমাকে বলেনি। ঐ জযবাহটা কিভাবে আনতে হবে তা তো বুঝছিনা। আমি বললাম, “শায়খ, সোয়ান্সী ছোট শহর। দশ হাজার মুসলিম এখান বাস করে। সিংহ ভাগ বাংলাদেশি। অন্যুন ১৫টা মুসলিম দেশের নাগরিকরা এখানে বাস করেন। আমাদের মিনবার থেকে আজ অবধি এমন খুতবাহ দেইনা যা ঐ দশ হাজার মুসলিমকে বিভক্ত করে দেয়। অথবা তাদের মনে এক জন আরেক জনের চেয়ে সেরা, এক দল আরেক দলের চেয়ে উত্তম, এক রেইস আরেক রেইসের চেয়ে ইসলামি এটা ঢুকে যায়”। তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, “আমিও এইটাই পছন্দ করি। তবে সহীহ আক্বীদাহ ও সহীহ তরীক্বার কথা আমি সব সময় বলি। তবে এটাও বলি যে, আহলুস সুন্নাহের গন্ডী কিন্তু ছোট নয়। এখানে ৪/৫টা মাযহাব তো আছেই, আধুনিক কালের জামাআত গুলোও আছে। অবশ্য ফিরক্বাহ ও নিহলাহ তো আলাদা বিষয়”।
আমি ডঃ আল-রাহওয়ানের কথার মোহনীয়তায় মুগ্ধ। বললাম, শায়খ প্রায় দুই হাজার ভাইবোন আজকের জুমুয়ায়। তাদেরকে আপনি খৃস্টীয় নতুন বছরে চোখ খোলা কিছু নির্দেশনা দেবেন ইন শা আল্লাহ।
কী সুন্দর ইংরেজী ভাষা ও এক্সেন্ট তিনি অর্জন করেছেন, ভাবতেই অবাক লাগলো! কয়েকটা বিষয় তিনি আমাদের সামনে চিন্তার জন্য দিলেন। প্রথমেই বললেন, আমার খুতবার প্রথম কথা হলো, “ব্যাক টু ব্যাসিক”। মানে মূলের দিকে প্রত্যাবর্তন। তিনি তার আলোচনায় একটা বিশেষ বিষয় আনলেন, আমি তা শুনে থ’ হয়ে গেলামঃ “সারা দুনিয়ায় এখন ক্লাস রূমে পড়ানো সেক্স এডুকেশান নিয়ে বাবা মা রা ভীষণ ভীত। আমি বলি আপনাদের এই ভয় কেন? দুনিয়া ভরা তাগুত ও পাপাচারের স্রোতে আমাদের ফ্যামিলি হয়ে উঠুক শিক্ষার সুন্দর নিকেতন। যেসব বিষয় গুলো ওরা স্কুলের কারিকুলামে পড়ছে তার ইসলামি দিকটা আপনি বাসাতেই শেখান। ডারইউনের বিবর্তনবাদ পড়ালে পড়াক। আপনি তাকে কুরআনের সৃষ্টিবাদের আয়াত গুলো পড়ে পড়ে শুনায়ে গোড়া শক্ত করে দেন। এর যুক্তির কাছে ক্লাসের পড়া নস্যির মত উবে যাবে। ওদের ক্লাসে যে সেক্স এডুকেশান দেবে, আপনি বাসাতেই তা সব পড়ায়ে দেন কুরআনের আয়নায়, হাদিসের নির্দেশনায়। এই সম্পর্কে কুরআন হাদীস এত প্রাণবন্ত, এতো সার্বিক এবং এতো স্বাভাবিক যে আপনার ছেলে মেয়ে এই গুলোই মেনে নেবে মুচকি হাসি দিয়ে। ক্লাসের বিষয় গুলো হবে তাদের ডিবেটের বিষয়। এবং বিশ্বাস করেন, আপনাদের রাগের চেয়েও তাদের ধীরতার সাথে দেয়া বুদ্ধিবৃত্তি সঞ্জাত ক্লাসের আলোচনা নিয়ে আসবে ধর্ম প্রচারের আরেক দিগন্ত। অন্যান্য ধর্মের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে এই গুলোই হবে ইসলাম পাওয়ার নতুন মাধ্যম”।
আমি কেঁদে ফেললাম। আমরা পাশ্চাত্যে কি ভয় পাচ্ছি এই বিষয় নিয়ে। শায়খ আমাদের এই থেকে মুক্তির সেরা পথ ই বলে দিলেন। আর তা হলো আমাদের ইসলামি ইতিহাসের সেই সালাফের পথ, যেখানে বাবা মা ই ছিলেন ছেলে মেয়ের প্রথম ও প্রধান বিদ্যালয়। ও ইসলামি শিক্ষার প্রধান ইঞ্জিনিয়র। তাদের কাছ থেকে ই তো আমরা পেয়েছি এই সব বিষয়ের মূল শিক্ষা।
বাল্যকালের যৌন পরিচ্ছন্নতার দিক ও বিভাগ বলে দেয়া, বয়ঃসন্ধিতে যৌন সম্পর্কের সাদা কালো দিক ও ক্ষেত্র স্পষ্ট করে দেয়া, ছেলে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের সময় বন্ধু হয়ে পথ নির্ণয় করে দেয়া, যৌবনে স্বাভাবিক ও অত্যন্ত সংবেদনশীল সম্পর্ক তৈরিতে পরিবারসুদ্ধ লোক এক হয়ে সাহায্য করা, দাম্পত্য জীবনের লীলায়িত মসৃন ও অমসৃন পথ চলতে রাহবারের ভূমিকা নিয়ে পাশে দাঁড়ানো – এই সব ক্ষেত্রেই তো পরিবার আমাদের সহায়ক হয়েছে। কিন্তু পরিবারের বাবা মা মূর্খ হওয়ার কারণে, অথবা ইসলাম সম্পর্কে না জানার কারণে, অথবা সময় দিতে অনীহার জন্যে, কিংবা আধুনিক যুগ-চাহিদার কাছে নিজদের নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় আজ আমরা বাচ্চাদের অন্যের হাতে বলী হতে দিচ্ছি।
দু’ সপ্তাহ আগে ফেনটন নামে এক ছেলে মুসলমান হয় আমার হাতে হাত রেখে। অনেক কথা হয় তার সাথে। আঠারো বছর বয়স তার। কেন মুসলিম হলো তার জবাবে তার বন্ধুদের কথা বললো। লন্ডনে এক কলেজে সে কিছু মুসলিমদের ক্লাসমেট হিসেবে পায়। তাদের কাছে সে ইসলামের অর্থ ব্যবস্থা, ফিক্বহ অফ রিলেশনশিপ, পরিবারের আনন্দালোক, সামাজিকতার বন্ধনে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা, সাংস্কৃতিক জীবনে শুচিতা ও সিদ্ধতার মূল বিষয়গুলো শুনে সে কনভিন্সড। সে মনে করে এমন জীবন ব্যবস্থা বাদ দিয়ে এক চোখ কানা সভ্যতার নিগড়ে থাকার যুক্তি হয়না।
জাযাকাল্লাহু খায়রান শায়খ প্রফেসর মুহাম্মাদ আল-রাহওয়ান, হাফিযাকাল্লাহু, ও আত্বালা উমরাক লিখিদমাতিল মুসলিমীন। আমীন।