সভ্যতা বিনির্মাণে “জামাআত বা “দলবদ্ধতা”তত্ব” । শায়েখ ডঃ আব্দুস সালাম আজাদী

ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণে “জামাআত” বা “দলবদ্ধতা” একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। দলবদ্ধ হয়ে ইসলাম মানা শুধু কুরআনের নির্দেশ না, শুধু আমাদের নবীর (সা) দেখানো পথ না, এটা ছিলো সকল নবী (আ) এর নবুওয়াতী রোডম্যাপ। এই “জামাআতি” কন্সেপ্ট টা আরো পরিস্কার হয় আল্লাহর নির্দেশঃ

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّـهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ তোমরা আল্লাহর রশি সকলে মিলে ধারণ কর, পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আলইমরানঃ ১০৩ এবং يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انفِرُوا جَمِيعًا
হে ঈমানদারগণ, তোমরা সতর্ক হও, দৃঢ়পদ হয়ে বের হও, অথবা সবাই একত্রে বের হও। সূরা নিসা ৭১, আয়াত দ্বয়ে।

এই “জামাআত” বা দলবদ্ধতার দর্শনটা ইসলামে আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিমদের একত্রে রাখার চেষ্টায় কাজ করতে হয় নিয়মিত। মনে রাখতে হয় এক জামাআতে অনেক ধরণের লোক থাকে। মদীনার জামাআতে প্রথম লগ্নে ছিলো মুসলিমদের দুটি স্পষ্ট গ্রুপ। একগ্রুপ ছিলো আনসার অন্যটা ছিলো মুহাজির। এদের নিয়ে আমাদের নবী (সা) একটা ইসলামি সভ্যতার জন্ম দেন। অবশ্য পলিটিক্স বা রাজনৈতিক অংগনে জামাআতের কন্সেপ্টটা আরো বড় হয়। তখন এটাকে “উম্মাহ” দর্শন বলে। এই “উম্মাহ দর্শন” উলামাগণ এতো বড় করে তুলেন যে, ইসলামী সভ্যতা হয়ে ওঠে একটা সার্বজনীন, মানবতাবোধে উজ্জীবিত, এবং সর্বোপরি আন্তঃধর্ম ও আন্তর্জাতিকতার সুতিকাগার।

তারা এই উম্মাহকে দুই ভাগে চিহ্নিত করে। একঃ উম্মাতে ইজাবাহ, বা যারা আমাদের নবী (সা)কে নবী মেনে তাঁর দেয়া পথ ও পদ্ধতি মেনে নিয়েছে। আরেকটা হলো, উম্মাতে দাওয়াহ, বা যারা আমাদের নবীর (সা) উম্মাত, তবে তাদের কাছে ইমানের দাওয়াহ নিয়ে যেতে হবে আমাদের। এতে গড়ে ওঠে এমন এক সাম্রাজ্য যেখানে মাইনরিটির অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যথা থেকে দেশের প্রজারা রক্ষা পায়। অনেকে অমুসলিমদের উপর অর্পিত “জিযিয়াহ” বা ট্যাক্সকে মাইনরিটির মাথার উপর বোঝা বা অন্য ধর্মপালনের শাস্তি হিসেবে মনে করেন। কিন্তু তারা খিলাফাতে রাশেদা, খিলাফাতে উমাইয়্যাহ, খিলাফাতে আব্বাসিয়্যার ঈমানদার ও ন্যায়বিচারক রাজা বাদশাহদের আন্ডারে থাকা অমুসলিমদের বিষয়ে খুব ভালো পড়াশুনা করেছেন বলে মনে হয় না। তাদের দেয়া ট্যাক্সের সাথে মুসলিম ধনী, আধা ধনী বা ন্যুনতম যাকাত দানকারীদের দেয়ার পরিমানের সাথে যদি তুলনা করতো তাহলে ঐ অভিযোগ তুলতে পারতোনা।

যাহোক, ইসলামি সভ্যতার এই রূপটা আমার মনে হয় খুব ই চমৎকার ছিলো। এখানে অমুসলিমদেরও মনে করা হয় সম্মিলিত সভ্যতার একেকজন সদস্য। আখতালের মত খৃষ্টান কবিও মুসলিম শাসকদের রাজদরবারে অন্যান্য মুসলিম কবিদের মত সমান মর্যাদা লাভ করেছেন।

কুরআন এই দর্শনকে ঐতিহাসিক করে তুলে ধরেছে। এরই আলোকে আমাদের নবী (সা) মদীনায় যে উম্মাহ তৈরি করেন তাতে মুসলমানদের পাশে ইয়াহুদী ও মুশরিক দের ও ইনক্লুড করেন। যা ছিলো একটা রাজনৈতিক মোর্চা। সেটা দীর্ঘস্থায়ী ছিলো কি না ছিলো তা নিয়ে আমি কথা বলবোনা, তবে তখনকার রাজনীতি বিজ্ঞানে এটা একটা সংজোযন যোগ্য অধ্যায় ছিলো সন্দেহ নাই। এখনো যারা রাস্ট্রগঠনে এই ধরণের মোর্চা তৈরি করতে চায়, তারা মদীনার সনদটা ভালোভাবে দেখতে পারে, এবং এগিয়ে যেতে পারে। কারণ আমাদের নবী (সা) এটা করেছিলেন নবুওয়াতী পন্থায়, কাজেই সেটাও আমাদের জন্য একটা অনুসরণযোগ্য বিষয়।

আমার আলোচনার বিষয় বস্তু হলো ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণে “জামাআতি” দর্শন। এখানে জামাআত বা “সম্মিলন” বা ঐক্যটা এমন ভাবে আনতে হয় যার মূলে থাকে কিছু ধারা, যা খুব ফ্লেক্সিবল হয়। ঐ ফ্লেক্সিবিলিটি রেখেই “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত” দর্শনটা উমাইয়া যুগে মুসলিম সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর আগে এই শব্দটাও আসেনি, এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি।

মুসলিমদের ইতিহাসে একটা সময় আসে যেখানে মুসলিম জামাআতের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের উদ্ভব হয়। এগুলো কোনটা ছিলো “হিযব” (গ্রুপ), কোনটা ছিল “ক্বাওম” (গোত্রীয়), কোনটা ছিলো “ফিরক্বাহ” (ছোট দল), কোনটা আবার ছিলো “তাইফাহ” (ঊপদল)। কোন কোনটা আবার “ইসাবাহ” বা স্থান, নির্দিষ্ট দর্শন অথবা ব্যক্তি কেন্দ্রিক কিছু সংগঠন উঠে দাঁড়ায়, যা সব স্থানে বা সব শ্রেনীর মাঝে বিস্তার করে। যেমন শিয়া মত, খাওয়ারিজ মতবাদ, মুরজিয়া মতবাদ, এই গুলো সবটাই রাজনীতি ভিত্তিক ধর্মীয় দল যারা “ইসাবাহ” কে ভিত্তি করে তৈরি হয়। আমাদের নবী (সা) প্রথম যুদ্ধে যখন যান, তার দুয়ায় এই শব্দটা ব্যবহার করেন, আল্লাহ যেন এই “ইসাবাহ” কে ধ্বংশ না করেন। ইবনে খালদুনের “আসাবিয়্যাহ” তত্ব এরই পরিবর্ধিত রূপ।

আমাদের উলামায়ে কিরাম “আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআতের” দর্শন মুসলিম সামাজিক জীবনে পরিচিত করার ফলে ইসলামি সম্রাজ্য বিভক্ত হলেও আমাদের মুসলিম সংহতিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সফল হন। এর মাধ্যমে আমাদের ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণে একটা নতূন দিগন্ত খুলে যায়। এর আলোকে সকল দল ও মত পথের একটা মুসলিম “মেইনস্ট্রীম” বানাতে সাহায্য করে। এর মূল কথা ছিলো, “কুরআনকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজ এগিয়ে যাবে। এবং এই কুরআনকে বুঝতে যেয়ে মহানবীর (সা) বানী ও আচরণকে অহীর মর্যাদা দিবে। সেই সাথে সাহাবাগণের অনুসৃত নীতিমালাকে করা হবে অহী প্রয়োগের প্রথম রৌল মডেল। এতে বলে দেয়া হয় ঐ তিনটির মডেলের উপর ভিত্তি করে জিহাদ ও ইজতিহাদ এর ভিত্তিতে সভ্যতার যাত্রা পথের স্রোতকে বেগবান করতে হবে”।

এখন আসে সভ্যতা সৃষ্টিকারী এই জামাআতের ব্যাষ্টি বা সীমানা নির্ধারণের প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে আনাস (রা) এর বর্ণিত আমাদের নবীর (সা) একটা হাদীস আমাদের সুন্দর পথ দেখায়। তিনি বলেনঃ
من صلى صلاتنا واستقبل قبلتنا وأكل ذبيحتنا فذلك المسلم الذي له ذمة الله وذمة رسوله فلا تخفروا الله في ذمته
যে আমাদের মত করে সালাত আদায় করে, আমাদের ক্বিবলাতে মুখ ফিরায়, আমাদের জবেহ করা প্রাণীর গোস্ত খায়, সে হলো ঐ মুসলিম যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রটেকশান পায়, যিম্মাদারী লাভ করে। কাজেই তার এই যিম্মাদারী পালনে গাদ্দারী করোনা, ভেংগে দিয়োনা। (বুখারী)

এই হাদীসকে সামনে রাখেন আমাদের সমাজবিজ্ঞানী আলিমগণ। তারা দ্বিধাহীন চিত্তে নবীর (সা) যুগ থেকে আসা নানান শ্রেনী ও পেশার মানুষকে এর সীমানায় গ্রহন করেন। কবি সাহিত্যিকদের যারা এই মূলনীতি গ্রহন করেন, তারা এখানে স্থান পায়। এখানে আসেন রাজনীতিবীদরা। এখানে আসে এমনকি তদকালীন “ইসলামি সাম্রাজ্য” এর রাজনৈতিক বিরোধী হওয়া ইমামগণ। হযরত আলীর (রা) বিরোধী আয়েশা সিদ্দীকা, তালহা, যুবায়ের, এমনকি মুআওয়িয়াহ রিদওয়ানুল্লাহি আজমাঈনকে এই সীমানায় আনা হয়। হাসান (রা) এর সন্ধির পরে যখন মুআওয়িয়াহ (রা) সারা মুসলিম সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন তখন তার বিরোধীদেরও এর সীমানায় আনা হয়। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা গ্রহনকারী ইমাম হুসায়নকে (রা) আহলুসসুন্নাতের ইমাম ও বলা হয়। আব্দুল মালিকের শাসনামলে বিদ্রোহকারী আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের শ্রেষ্ঠ ইমামদের মধ্যে গণ্য হন। এখানে বণিক শ্রেনী আলাদা ছিলোনা। শিল্পকারখানার মালিকরাও আলাদা নন। ফুক্বাহা গণ ও তাদের ইমামগণ এখানেও ইমাম। হানাফী, মালিকি, শাফেয়ী, হানবালী, এমনকি এবনে তায়মিয়্যাহর মত স্বাধীন ইজতিহাদের অধিকারীরাও এখানে শামিল। আক্বীদায় সালাফের দর্শনে ঋদ্ধরাও যেমন এখানে যায়গা পেয়েছে, আশআরী মাতুরিয়া মতবাদের অনুসারীদের কিছু কথা বাদ দিয়ে সব গুলো এখানে ধর্তব্য হয়েছে। এখানে মুহাদ্দিসগণের আধিপত্য প্রবল। একজন ইমাম তার কিতাবে ২৫ হাজারের মত দায়ীফ হাদীস বর্ণনা করেও আহলুস সুন্নাতের প্রখ্যাত ইমামদের শীর্ষে স্থান করে নেন। আসক্বালানী (র) বা নওয়ায়ীর (র) এর মত মুহাদ্দিস, ফক্বীহ, কিংবা শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ও আক্বীদার ক্ষেত্রে আশআরী হয়েও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের চোখের মণি হয়েছেন। হানাফী মাযহাবের অনুসারী হয়েও ইমাম তাহাওয়ীর আক্বীদা সবার পাঠ্য বই হয়েছে। হানবালী মাযহাবের ইবনে রাজাব (রা) কিছু কিছু ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মুখপাত্র হয়েছেন।

এই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত দর্শনটা ছিলো ইসলামি ইতিহাসের এক স্বাভাবিক ভাবে আসা প্রক্রিয়া, যার নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠাতা নেই। সকল দল, বিভাগ, সেক্টর ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে থেকেও নির্দিষ্ট বিষয়ে ঐক্যমত্য নিয়ে এসেছেন। একেই উসূলীনগণ “ইজমা’ সুকূতী” বা নিরব ঐক্যমত্যের বিষয় মনে করেন।

ইসলামি সভ্যতা যখন সারা পৃথিবীর সভ্যতা সমূহের উপরে বিজয়ীর ভূমিকায়, যদিও সে সময়টা ইতিহাসে খুব লম্বা সময় ছিলো তা বলবোনা, তখন এই “জামাআত” ছিলো একটা ছাতা বা আম্ব্রেলা অরগানাইজেশান। যার অধীনে প্রতিটি সেক্টর সমান ভাবে কাজ করে একই টার্গেটে অগ্রসর হয়। পৃথিবী আবাদ করার যে আমানাত এই মানুষ নিজ কাঁধে গ্রহন করে, আল্লাহরদ দাসত্ব করার যে মহান ব্রত বানী আদম স্বীয় স্কন্ধে তুলে নেয়, তা কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনায় সবাই অগ্রসর হয়।

তখনকার সময় এই সভ্যতার একটা শ্লোগান ছিলো বড় মজার। শ্লোগানটা আমাদের নবী (সা) বলে দেননি। খুলাফাগণের কেও এটা বলেননি। কিন্তু সাহাবাগণের মধ্যে অনেকটা অখ্যাত রিব’ঈ ইবন আমের এটা উচ্চারণ করেন মহাবীর রুস্তমের সামনে। রুস্তম তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি মুসলিমদের নেতৃস্থানীয় কেও। তিনি বলেন, না সাধারণ একজন, তবে আমরা সবাই এক দেহের মত। কিসের জন্য এই বড় কাদেসিয়্যার যুদ্ধ হতে যাচ্ছে- তার জবাব রুস্তম জানতে চান। তিনি বলেনঃ
الله ابتعثنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام،
আল্লাহ তাআলা আমাদের পাঠায়েছেন, যাতে তাঁরই ইচ্ছা মতে আমরা মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে তাঁর দাসত্বে বের করে আনি, তাদের কে দুনিয়ার সংকীর্ণ নিগড় থেকে প্রশস্ততার আঙিনায় নিয়ে আসি, তাদেরকে ধর্মের জুলুম থেকে ইসলামের ইন্সাফের কোলে নিয়ে আসি। (আলবিদায়াহ ওয়া আলনিহায়াহ, ৭ম খন্ড)
এই শ্লোগানটাই পরে হয়ে যায় ইসলামি সভ্যতা বিস্তৃতির মূল মন্ত্র। মানুষের কল্যান সাধনই হয় এই সভ্যতার একমাত্র টার্গেট।

ইসলামি রাস্ট্রের বিভিন্ন সেক্টর তৈরি হয়। প্রতিটা সেক্টরে কাজ করতে পারার উপযোগী করে গড়ে তুলতে থাকে ইসলামি শিক্ষাদানের গুরুরা। তারা মনে রাখতো একটা জিনিষ, তা হলো “নীড বেইজড এডূকেশান” প্রয়োজন অনুযায়ি শিক্ষা। এটা তৈরি হয় ইসলামের ‘ইলমুন নাফি’ (উপকারী জ্ঞান) বা ‘ইলমুন ইয়ুন্তাফাউ বিহি’ (উপকৃত হওয়া যায় এমন জ্ঞান) কন্সেপ্ট থেকে। ফলে ইসলামের ইতিহাসে কখনো শিক্ষিত বেকার ছিলো না। এরা ছিলো ইসলামি সভ্যতার এক্কেবারে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় আসে নানা শাখা প্রশাখা। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম তত্ব সব গুলোই ছিলো সভ্যতার ই অবিচ্ছেদ্য অংগ। এখানে আসে ভূবনখ্যাত কবি সাহিত্যিক। তাদের লেখা নিয়ে তৈরি হলো সভ্যতা। তারাও এর অংশ। মোট কথা ইসলামি রাস্ট্রব্যবস্থায়, অথবা মানব জীবনে দরকারী সব কিছুতেই ইসলামি সভ্যতা অকাতরে দান করে যায় ঐশ্বী পথনির্দেশনা।

ইসলামি সভ্যতা তৈরিতে কাজ করা ইসলামি দলগুলোকে এই জিনিষটা এখন আসলেই ভাবতে হবে নতুন করে। কোন নির্দিষ্ট দল, গোষ্টি, সংস্থা বা ব্যক্তি একা এটা তৈরি করতে পারেনা।

আমার জীবনে উলামাগণের সাক্ষাতের সবচেয়ে মধুর স্মৃতির মধ্যে একটা হলো ডঃ ইউসুফ আলক্বারাদাওয়ীর সাথে থাকা কিছু ঘন্টা। অনেক গুলো প্রশ্ন করেছিলাম তার কাছে। একটা ছিলো ইসলামের দল করা নিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, শায়খানা, এই যে আমরা এখন “তাহাযযুব” বা নানা দলে বিভক্ত হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি, এটাকে কোন ভাবে ইতিবাচক করা যাবে? আমার কাছে তো সব নেতিবাচক মনে হয়। তিনি হেসে বললেন, তুমি কি সব ব্রেইনকে একমাথায় নিয়ে আসতে চাও। ইসলামের সৌন্দর্য তো এখানেই যে সবাই আলাদা সত্বা নিয়ে সবাই এক। আলইততিফাক মাআল ইখতিলাফ। সবাই ইসলামি সভ্যতা পুনরুদ্ধারের সমান সারির কর্মী। সবার কাছ থেকে ই নিতে হবে সৌন্দর্য ও শক্তি। কোন দল একা একা কিছু করতে পারেনা।

এই আইডিয়া টা আমি নিয়েছিলাম মালায়েশিয়ার ইমাম নিক আব্দুল আযীযের (র) কাছ থেকে। তিনি কেলানতানে এবং পরে সারা মালয়েশিয়ার ইসলামি মোর্চা গুলোকে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাবলীগের দিল্লীর মুরুব্বীদের কে দাওয়াত করে মালয়েশিয়াতে নিয়ে আসেন। এবং পলিটিক্সের ব্যাপারে তাদের সাথে একটা বোঝা পোড়া করেন। তিনি মুরুব্বিদের বলেনঃ আপনারা পলিটিক্স করেন না, ওটা আমরা করি। আপনাদের জন্য যে কাজ গুলো আমরা করবো তা হলো আমাদের সমস্ত মসজিদ গুলোকে তাবলীগের কাজের জন্য আপনাদের কাছে ছেড়ে দেবো। সেখানে মুসলমানদের নামাজি বানানো, ইসলামের মৌলিক জিনিষ শিখানো, এবং এদের চরিত্র সংশোধনের কাজ গুলোর দ্বায়িত্ব আপনারা নেন। আমরা অর্থ ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে আপনাদের সার্বিক সাহায্য করবো। এমন কি আমাদের বড় বড় প্রোগ্রাম গুলোতেও আপনারা আসবেন। বয়ান দেবেন। তাদের যেভাবে আপনারা ভালো মনে করেন, রূহানিয়াত বাড়ানোর কাজে ব্যয় করবেন। পলিটিক্স করা যেহেতু হারাম না, কাজেই এটা করতে আপনারা কাওকে নিষেধ করবেন না। আর ভোট দেয়ার সময় কাকে ভোট দিতে হবে এটা না বলতে পারলেও, ‘ইসলাম বিরোধী কোন শক্তিকে ভোট দেয়া যাবে’ এটা অন্তত বলবেন না। আরেকটা কাজ আপনারা করবেন, তা হলো, আপনাদের মসজিদ গুলোতে আমাদের ঢোকার সুযোগ দেবেন। পলিটিক্সের ব্যাপারে কথা না বলতে দেন, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা বা সেমিনার করার সুযোগ দেবেন।

উনার কথা এত যুক্তি যুক্ত ছিলো যে তাবলীগ জামাআত ঐ বৈঠকেই বসে তার সাথে একমত হয়ে যায় এবং তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য দিল্লীর নিযামুদ্দিনের মুরুব্বিরা তাদের মালয়েশিয়ান দ্বায়িত্বশীলদের কে নির্দেশ দিয়ে যান। শুধু তাবলীগ না, যারাই ইসলামের কাজ করতো তাদের সাথে তিনি বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আলআরকাম গ্রুপের সাথে মতানৈক্য থাকলেও তিনি সদ্ভাব বজায় রাখতেন। আবীমের আনওয়ার ইব্রাহিম তাকে সব সময় শিক্ষকের মর্যাদা দিয়ে এসেছেন। এক স্মৃতি চারণায় আনওয়ার ইব্রাহিম বলেনঃ যখন ই ইসলামি ও রাজনৈতিক কোন ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিতাম, তুয়াং গুরুর কাছে যেতাম। যখনই রাজনৈতিক সম্পর্কে কোন মারাত্মক বিভেদ দেখা দিত, তার হস্তক্ষেপ আমি কামনা করতাম। তার কোন কথা কেও ফেলতে চাইতোনা।

বাংলাদেশের ইসলামী জ্ঞান রক্ষণাবেক্ষণে এখনো ক্বাওমী মাদ্রাসা শীর্ষে। তাদেরকে বাদ দিয়ে অথবা দূরে রেখে ইসলামি সভ্যতা নির্মাণে কাজ করা “জামাআতি” কন্সেপশানের বিপরীত। তাবলীগের প্রভাব ইসলামী আমলী জিন্দেগীতে সুন্দর প্রভাব ফেলেছে। তাদের দাওয়াতী কার্যক্রমে অন্যন্য ইসলামি আন্দোলন গুলো শরিক হতে পারে সাহায্য নিতে পারে। একবার আমি মীর কাসিম আলী সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জামায়াত ইসলামি ও তাবলীগ দা কুমড়ার সম্পর্ক নিয়ে বাস করে। আপনি জামায়াতের এত বড় নেতা হয়েও তাবলীগের বিশ্ব ইজতিমায় ইবনে সিনার এত বড় সার্ভিস দেন। তিনি স্বভাব সুলভ হেসে বলেন, তারা একান্তভাবে দ্বীনের খাতিরে এই ভাবে আকাশের নিচে বসে ইবাদাত করে। এরা অসুস্থ হলে তাদের খেদমাত না করলে আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবো? তাবলীগের ভায়েরা যদি ভাবতেন, আমরা রাজনীতি করিনা তাতে কি, যারা ইসলামের পক্ষে আছে তাদের আমরা সাহায্য করবো। আহলে হাদীসের ভাইয়েরা সহীহ হাদীস ভিত্তিক এমন এক জীবনাচরণের দিকে আমাদের টেনে আনে যা থেকে আমাদের মহানবীর (সা) কাজের অনেক কিছু সহীহ ভাবে দেখা যায়। এরা সবাই যদি একে অপরে এক হতো দেশে নাস্তিকতার ত্রাহী অবস্থা হয়ে যেতো।

মুসলিম দেশে ইসলামকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে না পারায়, শয়তানের সফল প্লানের চেয়ে আমাদের অনৈক্যকে আমি দোষ দেই। আরো সমস্যা হয়েছে আমাদের মুসলমানদের দেশে এই জামাআতী দর্শনটা কে আমরা “হিযবের” দর্শনে পরিনত করেছি। হিযবের দর্শন হলো খুব স্পর্শ কাতর। হিযবের মূল নীতি যদি হয় আলাদা থাকা এবং “কুল্লু হিযবিন বিমা লাদায়হিম ফারিহুন” প্রত্যেকেই নিজেদেরটা নিয়েই আত্মতৃপ্তিতে থাকা, তা হলে তা হবে শয়তানের প্ররোচনা।

আমি একবার এক সংগঠনের প্রোগ্রাম শুনছিলাম মসজিদে বসে। তাদের প্রোগ্রাম হচ্ছিলো একটা পর্দা টাঙিয়ে। আমি তাদের কর্মী বৈঠক অদ্যপান্ত শুনলাম। আমি প্রোগ্রাম শেষে দ্বায়িত্বশীল ভাইকে বল্লাম, ভাই আপনি কি উমুক দল করেন? উনি আস্তাগফিরুল্লাহ বলে বল্লেন, তা কেন? আমার পার্টির নাম তো এই। আমি আরো তাজ্জব হয়ে বললাম, না ভাষায়, না পদ্ধতিতে, না সাহিত্যে, না সংবিধানে আপনারা উমুক দলের থেকে আলাদা। তাহলে আলাদা ভাবে কেন দল করলেন?! একই মানহাজের মানুষ যখন দুই ভাগে ভাগ হয় তখন আমি খুব ভয় পাই। এইটা ইসলামে খুব নতুন। বিভিন্ন মুখি দল বিভিন্ন হয়। ফক্বীহদের মানহাজ ও মুহাদ্দিসদের মানহাজ এক না। কিন্তু মৌলিক যায়গার তারা এক। অথচ একই মানহাজের অধিকারী হয়ে একে অপরের ধ্বংশ কামনা করা হলে বুঝতে হবে আমাদের “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত” কনসেপশানে সমস্যা আছে।

বাংলাদেশের ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণকারী দল গুলোর আরেকটা জিনিষ ভাবতে হবে। তাহলো মুসলিম দেশে “ওদের” ও “আমাদের” দৃষ্টিভংগী সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের দ্বীনদার দের একটা বড় অংশ নিজদেরকে বাংলাদেশ যে সব শক্তি চালায় তাদের কেন্দ্রে থাকা হারাম মনে করে। এইটা করে বাংলাদেশের চালিকা শক্তি গুলো ভালো মুসলিমদের থেকে শুন্য হয়ে যাচ্ছে।

তুরস্কে এরদোয়ানদের দীক্ষা গুরুর নাম ফেতুল্লা গুলেন। দেশকে ইসলামি করণের প্রথম দিকে তিনি ৩টি সেক্টর বাছাই করে নেন। সেনাবাহিনী, জুডিশিয়ারী এবং শিক্ষা ও মিডিয়া। তিনি এগুলো নিজের হাতে এনেছিলেন। কিভাবে এনেছিলেন তা আলোচনা আরেকদিন করা যাবে।

মুসলিমদেশের মুসলিমরা “ওরা” বা “আমরা” করলে ক’দিনের মধ্যেই দেশ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

আমি একবার এক বড় দ্বায়িত্বশীলের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভাই, এই যে আপনারা বি এন পি, আওয়ামিলীগ, এমনকি বামদের সাথে যখন মোর্চা গুলো করেছিলেন, তখন তারা কি আপনাদের সকল কথা গ্রহন করতো? তিনি হেসে বলেছিলেন, না কিছু ছাড় দিতে হয়। ঐক্য করতে গেলে গিভ এন্ড টেইক, দেয়া নেয়া একটা বড় ফ্যাক্টর। আমি বললাম, ঐটা কি ইসলামী দলগুলো এক করতে যেয়ে সম্ভব হবেনা? তিনি মুখের দিকে তাকালেন। কিছু কথা বললেন। সেগুলো ছিলো তার দীর্ঘশ্বাস। ইসলামি দলগুলো ঐক্যের ব্যাপারে দিতেও চায়না, নিতেও চায়না। অথচ সেক্যুলাররা দেয়া নেয়ায় ভালোই করে দেখছি।

সভ্যতা বিনির্মাণে “জামাআত বা “দলবদ্ধতা”তত্ব” । শায়েখ ডঃ আব্দুস সালাম আজাদী

About The Author
-

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>