ছোট বেলায় এই কথা টা শুনেছি এক গভীর রাতে। মাওলানা আমানাতুল্লাহ “সীমান্ত বুলবুলি” নামে একজন খুব ভালো শায়খ ছিলেন আমাদের এলাকায়। তার আলোচনা শুনতাম, মুগ্ধ হয়ে যেতাম। রাত গভীরে গোবিন্দপূরে এক সভায় তিনি এই শ্লোক টা গেয়েছিলেন। মনে রেখাপাত করেছিলো সেই ছোট্ট বয়সে। মুখস্ত ও করে নিয়েছিলাম চার পদের ছোট্ট এই কবিতা।
যেদিন প্রথম তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদে ছিলে তুমি আর হেসে ছিল সবে
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন
মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন!!
ভাবতাম, আমি মরে গেলে ভুবন কাঁদবে? পরে যখন কুরআন বুঝতে শিখেছি, এবং বরকত হাসিলের নিয়তে সুরা দুখান মুখস্ত করার চেষ্টা করেছি, একটা আয়াত বারবার পড়ে ভাবতাম, আহ, কত সুন্দর করে আল্লাহ তাআলা বলছেনঃ (ঐ ফিরআউনরা মারা গেলে) আসমান জামীন কাঁদেনি, তাদের জন্য কোন কিছুও অপেক্ষমান ছিলোনা, তাদের রেহাই ও ছিলোনা। (সুরা দুখানঃ ২৯)।
আমি তখন ভাবতাম, আহ, আমি এই বিশাল আসমান জামিনের অবিচ্ছেদ্য কিছু। মনে হত, মানুষ না হয় আমার জন্য কাঁদবে, আমি মানুষ তাই। কিন্তু সারা আসমান ও জামিন ও আমার জন্য কাঁদবে?!
আসলে আমি যখন আল্লাহর নাম নেই, তাঁর ডাকে সাড়া দেই, সাজদায় পড়ি, ডুকরে উঠি, বলি, সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা। এর সাথে অনুরনন ওঠে আসমান সমূহে, জামীনের পরতে পরতে, সবাই আমার মত, কিংবা আমার চেয়েও হয়ত সুন্দর করে তাসবীহ গেয়ে ওঠে ঐকতানে। আমি হয়ত বুঝিনা। (ইসরাঃ ৪৪)।
দাঊদ (আ) এর কণ্ঠে যখন যাবুর গীত হতো, মাছেরা ভেসে আসতো, পাহাড়েরা তার সাথে সুর মিলাতো, (সূরা সাবাঃ ১০)। মানুষ যখন হজ্জে যায়, মন দিয়ে তালবিয়্যাহ পড়ে, সাথে সাথে ডানে বামে পৃথিবীতে এই শব্দ যত দূর যায়, সেখানে যত পাথর, সমস্ত গাছ, বাড়ি কিংবা স্থলভাগের নানা সৃষ্টি – সবাই তার সাথে সাথে তালবিয়্যাহ পড়ায় সুর মিলায়, (তিরমিযী, ইবন মাজাহ, সাহল ইবন সা’দ থেকে)। এই মানুষটার ইন্তেকালে ওরা সবাই কাঁদবে না তো কি?
আমাদের চারপাশের কত জন্তু জানোয়ার, কত পোষা অপোষা প্রানী, কত বর্ণের ও প্রকারের পাখি। ওদের সাথে, বুঝি আর না বুঝি, আমাদের প্রাণের মিল হয়ে ওঠে। যে ঘোড়াটাও আমাদের বয়ে বেড়ায়, সেই নাকি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দুয়া করে। বলে, ও আল্লাহ, আদম সন্তানের যার অধীনস্ত তুমি আমাকে করেছ, তার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে আমাকে বেশি প্রিয়তম করে দিয়ো, তার সেরা সম্পদ আমাকে বানায়ে দিয়ো। (আহমাদঃ আবু যার থেকে)। যখন কোন আলিম রাস্তা দিয়ে হেঁটে শিক্ষা প্রসারে বের হয় তখন আসমান সমূহে যারা আছে, জামিনে যারা বাস করে, এমনকি পানিতে বাস করা মাছেও তাদের জন্য দুয়া করে। (তিরমিযীঃ ২৬৮২)। কেউ সালাতের জন্য যখন আযান দেয়, আমাদের নবী (সা) তাকে জোরে আযান দিতে বলেছেন। কারণ এতে করে মানুষ, জিন, গাছ, পাথর যে-ই এই আযান শোনে, ক্বিয়ামতে তার পক্ষে সবাই গিয়ে সাক্ষ্য দেবে। মানুষের সাথে আসে পাশের সমস্ত সৃষ্টির এইভাবে সম্পর্ক হয়ে যায়। এইজন্য তাদের চেনা এই মানুষটা মরে গেলে কাঁদে, আসমান জামিনের সাথে একাত্ম হয়েই কাঁদে। কিন্তু আমাদের সেই সম্পর্ক কি চার পাশের সাথে এইভাবে হয়? আমাদের তো অবস্থা এই, আমরা এখন যত বেশি একান্ত, তত বেশি দূরাচার।
মানুষ যখন ঈমান আনে, তাক্বওয়ার অধিকারী হয়, তখন আল্লাহ আসমান জামিনকে তার জন্য অধীন করে দেন। এরা তখন বরকাতের দরোযা সমূহ আল্লাহর নির্দেশে তার জন্য খুলে খুলে দেয়। (সূরা আ’রাফঃ ৯৬)। ইবনে আব্বাসের কাছে সূরা দুখানের ২৯ নাম্বার আয়াতের কথা বলা হয়েছিলো, আবু আল আব্বাস, আসমান জামিন কেন এই মানুষের জন্য কাঁদে। তিনি বলেছিলেন, এই ভালো লোকের আমল যখন আসমানে উঠতো সেখানে তার সুরভি থেকে যেতো। আসমান থেকে নেমে আসা মালাইকাহ তার কথা মনে রাখে। ফলে তার ইন্তেকাল হলে ঐ সব যায়গা তাকে মিস করে।
যখন কোন মানুষ ঈমান ও তাক্বওয়ার আলোতে রাস্তায় হাঁটে, নামাযে যাতায়াত করে, মানুষের উপকারে ব্রতী হয়, খারাপ কাজ হতে লাগলে প্রতিরোধে এগিয়ে আসে, ভালো কাজ প্রমোট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, দুনিয়ার সবাই তাকে মনে রাখে। তার ইন্তেকালে তাই চোখে চোখে পানি ঝরে যায়, হৃদয়ে হৃদয়ে ব্যাথা অনুভূত হয়, আর সারা যায়গায় শুধু খালি খালি লাগে।
আমাদের নবী (সা) একবার বলেছিলেন, এই যে অহুদ পাহাড় দেখছো, এ আমাদের ভালোবাসে, একেও আমরা ভালোবাসি, (বুখারী)। এইভাবে প্রকৃতির সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আমরা প্রকৃতির পূজা করিনা, তাকে ভালোবাসি বলেই আমাদের ইন্তেকালে ওরা কেঁদে বেক্বারার হয়। ঐ জন্য আমাদের নবী (সা) বলেছেন, তুমি কখনো বাতাসকে অভিশাপ দিয়োনা। কারণ সেতো আদিষ্ট (তিরমিযী: ১৯৭৮)। যে সব খাদ্য গুলো থেকে জিনেরা উপকৃত হয়, সে হোক গোবর, কিংবা হোক হাড় গোড়, আমাদের নবী (সা) সেগুলোকেও ভালো অবস্থায় রাখতে বলেন। ঐ গুলো দিয়ে যেন পেশাব পায়খানার পবিত্রতা অর্জন করা না হয় তার জন্য তিনি নিষেধ করেছেন, (মুসলিম)। একজন মানুষ যখন এইভাবে দুনিয়ায় সবার দিকে খেয়াল রেখে চলে, তার ইন্তেকালে আসলেই আসমান জামিন কান্না ভেঙে পড়ে।
একজন ভালো মানুষের সাথে সম্পর্ক হয় মালাইকাদের। সে সম্পর্ক হয় অত্যন্ত স্পষ্ট ও তা যে কেও অনুভব করতে পারে। আরশ বহন করা মালাইকাগণ, কিংবা আরশের আসে পাশে থাকা সৃষ্টিরা মুমিনদের জন্য দুয়া করে। তাদের দুয়ার ভাষাটাই কী চমৎকার। রাব্বানা ওয়াসি’তা কুল্লা শাইয়িন রাহমাতান ওয়া ইলমা। ও আল্লাহ তুমি তোমার রহমাহ ও ইলম দিয়ে সব জিনিষকে ছড়িয়ে গেছো, তুমি তাওবাহকারীদের ক্ষমা করো, ক্ষমা করো যারা তোমার পথ অনুসরণ করেছে। আর তুমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও (সূরা গাফিরঃ৭)। যারা জ্ঞানের আহরণে বেরিয়ে পড়ে, তাদের পথে মাইলাইকাহরা পাখা বিছিয়ে স্বাগত জানায়। মানুষেরা কোথাও বসে আল্লাহর যিকির করলে, তার স্মরণে বৈঠক চালালে, সেখানে নেমে আসে মালাইকার সারি। তারা আল্লাহর নির্দেশে চারপাশে দাঁড়ায়ে যায়, নাযিল হতে থাকে রাহমাহ, মনে মনে নেমে আসে জান্নাতি শান্তি। যারা মাসজিদে আসে, আগে থেকেই মালাইকাহ দরোযায় তাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, যাতে করে নাম লেখার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে। এইজন্য আমাদের নবী (সা) মালাইকাদের কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, তোমরা যেসব দূর্গন্ধে কষ্ট পাও, মালাইকারাও সেই সবে কষ্ট পায়। আমাদের নবী (সা) শরীর সুগন্ধিময় করে রাখতেন। পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ নিয়ে, বিড়ি সিগারেটের দুর্গন্ধ মুখে লাগিয়ে, কিংবা ময়লা মোজার বাজে গন্ধ নিয়ে মাসজিদে না যাওয়া উচিৎ।
মানুষ জন্মের পর থেকে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল। ওর ভালো ব্যাবহার ও ঈমানী বাহার দেখে মা বাবার চোখ শীতল হয়। ওর ব্যবহারে ভাই বোনের রক্তে ভালোবাসার ঢেও বয়। শিক্ষকগ্ণ মাথায় তুলে রাখে, সতীর্থরা থাকে তার জন্য পাগল। তার প্রেমে স্ত্রীর মন কেনা হয়ে যায়, ও তার ভালোবাসায় তার জন্য ছেলে মেয়ে হয় জীবন উৎসর্গকারী। পাড়া প্রতিবাসীরা একদিন দেখা না পেলে তাকে খোঁজা খুঁজি শুরু করে। দ্বায়িত্বশীলেরা তার জন্য দুয়া করে, গর্ব করে। অধিনস্তরা তার জন্য প্রাণপাত করে। তার উন্নতির জন্য রাতদিন ও বিশ্রাম ও নিতে অনিহা করে। এই মানুষ যখন মানুষের সমাজে থাকে আল্লাহর কাছে দুয়া করে, ও আল্লাহ আমাকে মাফ করো, আমার বাবা মাকে ক্ষমা করো, আর আমার ঘরে যারা বিশ্বাসী হয়ে ঢুকেছে, কিংবা অন্যত্র যে সব নর নারী ঈমানের অধিকারী হয়েছে, তাদেরকেও ক্ষমা করো। (নূহঃ ২৮)। এই মানুষ আল্লাহর কাছে হাত উঠালে বলেঃ ও আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করে দাও, আর আমাদের যে সব ভাই আমাদের আগে ঈমান নিয়ে ইন্তেকাল করেছেন, তাদের তুমি মাফ করে দাও, (সূরা হাশরঃ ১০)।
এই মানুষটা যখন মরণের বিছানায় শুয়ে পড়ে, সারা দুনিয়ায় যেন খবর হয়ে যায়। মানুষের ঢেও এসে আছড়ে পড়ে চার পাশে। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর” তালক্বীন শোনা যায়। এতে আসে সাহস, আসে জান্নাতী বরাভয়, আসে মনের মাঝে আরশের ছায়া।
মানুষটা মারা গেলে নেমে আসে শোকের ছায়া। কান্নার ধ্বনি কলিজা বিদীর্ণ করে, ঝরে পড়ে অশ্রুর বান। জানাযায় মানুষের ঢল, কবরস্ত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের মিছিল। তার জন্য দুয়া হয় পৃথিবীর কর্ণারে কর্ণারে। যেন দুনিয়া ও আসমান এক সাথে মানুষের কান্নায় একাত্ম হয়।
মানুষ কাঁদে, আর ঐ মৃতের মুখে আটা স্নিগ্ধ হাসির রেখা দেখে বলে “ওয়াজাবাত”। তোমার জন্য হে মানুষ জান্নাত আজ অবধারিত।
মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন।