“সালাম ভাই, আপনাকে এইভাবে বলছি বলে রাগ কইরেন না”।
-“না, তা কেন করবো। আপনি বলেন”।
– “দেখেন আমি ইতিহাসে আপনাকে বেশি দূরে নেবোনা, আমি গত ৮০/৮৫ বছর থেকে আপনাকে বলছি বাংলাদেশে আমার এলাকায় ৯০% মেয়েদের সম্পত্তি ঠকিয়েছে তাদের বাবা, ভাই, ছেলে সবাই। কেও ই নির্ধারিত হিসাব মত, ফারায়েযের নিয়ম মত, কুরআন হাদীসের বিধান মত সম্পত্তি মেয়েদের বুঝিয়ে দেয়নি”।
নড়েচড়ে উঠলাম আমি। কথায় অসম্ভব খেদ, অন্যরকম শ্লেষ এবং গলায় ক্ষুরের চকমকানি। বলে চলছেনঃ “আমি আমার দাদীর সম্পত্তির কথা জানি, ফুফুদের জমির কথা জানি, বোনদের অবস্থা নিজে চোখে দেখেছি। সালাম ভাই, এতো বড় জুলুম মুসলিম মেয়েদের সাথে করা হয়, যা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে”।
আমি এবার স্মৃতির সাগরে ডুবে গেলাম, অবশ্য ভদ্রতা বজায় রাখতে চোখ রাখলাম প্রাজ্ঞ এই প্রফেসরের ঠোঁটের ফাঁকে।
আমি দেখলাম আমার গ্রামের মেয়েদের দিকে। হাতড়িয়ে পেলাম অনেক মুখ যারা আজ কবর দেশে শায়িত, কিন্তু আমাকে অনেক আদর করে গেছেন। ওদের কাউকে আমার আব্বা আম্মা দাদী বলে ডাকতেন, কাউকে মা বা চাচী বা ফুফু বা খালা বলে ডাকতেন। যারা আব্বা আম্মার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া হতেন। যারা আব্বা আম্মার ছিলেন বোন, চাচাতো বোন, খালাতো বোন, মামাতো বোন বা দূরের আত্মীয় স্বজন। আমি এই মিছিলে দেখলাম আমার ফুফুদের, চাচীদের, খালাদের, মামীদের, দাদীদের কিংবা প্রতিবেশীদের। আমি দেখলাম আমার বোনদের ফ্যাকাশে মুখ, চাচাতো বোনদের গোঙানো কান্না, এবং ফুফাতো বা খালাতো বা মামাতো বোনদের নৈর্ব্যক্ত, অনুক্ত বা অনুচ্চারিত খেদ ও অভিযোগ। সম্পত্তির যথাযথ ভাগ কেউ- ই পায়নি।
মুসলিম সমাজের এত বড় জুলুম, এত বড় অত্যাচার, নারীত্বের উপর এত ভয়াবহ নিগড়! ও আল্লাহ, এই মুসলিমদের তুমি এখনো ভালো রেখেছো!! ও আল্লাহ, তুমি সত্যিই রহমান, রাহীম, তুমি সত্যিই সাবূর অসম্ভব ধৈর্যশীল। তুমি বলেছো তুমি জালিমদের পথ দেখাও না, পছন্দ করোনা। তোমার হাবীব বলেছেন, জুলুম জালিমের জন্য কিয়ামতে অন্ধকার নিয়ে আসবে। তোমার হাবীব বলেছেনঃ এক ইঞ্চি পরিমান জমিন যে ফাঁকি দেবে সাত তবক পর্যন্ত মাটি কিয়ামতে তার গলায় পরিয়ে দেয়া হবে।
মনে পড়ে গেলো আমার গ্রামের এক বিশাল ধনীর কথা। আমার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন সময়ে তিনি হজ্জে যান। মসজিদে নবওয়ীতে বসে তিনি তার সম্পত্তির হিসাব দিচ্ছিলেন। কি করে আসলেন তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বললেন, তার একমাত্র ছেলে সম্পত্তির বিশাল ভাগ পেয়েছেন। প্রায় সত্তর বিঘার মত সম্পত্তি তিনি লিখে দিয়ে এসেছেন। মনে মনে খুশি হলাম। বললাম, মাশাআল্লাহ তাহলে তো চাচা, আমার বন্ধু মানে আপনার জামাতা অনেক ধনী হয়ে গেছে। আপনার মেয়ে তো নিশ্চয় পঁয়ত্রিশ বিঘা সম্পত্তি পেয়েছে। এই সম্পত্তি তো আমার বন্ধু ও তার ছেলে মেয়েরা পেয়ে যাবে আপনার মেয়ের মাধ্যমে। চাচা থতমত খেলেন, আচাক্কা দিলেন। তা কি করে? আমি ওদের দশ বিঘা করে লিখে দিয়ে এসেছি।
আমি নবী (সা) এর রওদার পাশে বসে এই প্রগলভ ও মারাত্মক জালিমের মুখের দিকে তাকিয়ে আদব কায়দা কিছুটা দূরে সরিয়ে বললাম, “চাচা আপনি মদীনা থেকে আর মক্কায় যাবেন না প্লীজ, দেশে ফিরে যান। হজ্জ আপনার আর করার দরকার নেই”। তিনি জোর দিয়ে বললেন, মেয়েরা সত্যিই খুব ভালো জামাই পেয়েছে, সবাই ধনীর দুলালদের হাতে পড়েছে। কাজেই আমার সম্পদ দেয়ার দরকার নেই। দশ বিঘা ই তাদের জন্য যথেষ্ঠ। বললেনঃ বাবা বয়স এখন নবীন, তাই সব এখনো বুঝবানা। আমি এই জালিমের কাছ থেকে উঠে মসজিদে নববীর লাইব্রেরীতে যেয়ে বই এর দংগলে বসে বাংলাদেশের পাংশু মুখের নারীদের প্রতি অন্তরের দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।
দেখলামঃ বাবা মারা গেছে আজ ৩০ বছর হয়ে গেছে। বোনেরা ভাইদের মুখের দিকে তাকিয়ে। ভাইয়েরা বছরের পর বছর বোনদের জমির ফসল খেয়ে যাচ্ছে। একবার মুখেও বলেনা, ‘বোনেরা আয় তোরা, তোদের জমি গুলো বুঝে নিয়ে যা’। দেখছি অনেক বোন রোগে শোকে হত বিহ্বল। দারিদ্র্যের কষাঘাতে মৃত্যুর মুখোমুখি। ভাইয়েরা বিল্ডিং এর পর বিল্ডিং বানাচ্ছে, একতলার উপর আরেক তলা দিচ্ছে, আর বোন ঐদিকে ক্ষুদ্র কুড়ে ঘরে হাফ ঢাকা চালের নিচে বোবা বধির ছেলে নিয়ে অশ্রু সজল হচ্ছে। বোন রোদে পুড়ে, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে আর ভাই গুলো সমাজের কেও কেটা হয়ে উঠছে, মুসলিম নাম নিচ্ছে, হাজি সাহেব খিতাব নিচ্ছে আর জায়নামাজে দাঁড়িয়ে কিংবা সাজদা দিয়ে আল্লাহর অলী হবার ভাণ করে যাচ্ছে।
আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম আমার বোনদের মাঝে এক অসহায় ভাই হিসেবে, যাদের অর্থের কতই না প্রয়োজন, অথচ তারা আমার আব্বার জমি থেকে কিছু যে পাবে তা বেমালুম যেনো ভুলেই গেছি। হায়রে আব্দুস সালাম আজাদী, তুমিও এই সব মেয়েদের ফাঁকি দেয়ার তালেই আছো।
প্রফেসর সাহেব জোরে চিৎকার দিলেন। ভাইজান, কত বিধবা কে আমি ধুকে ধুকে মরতে দেখেছি, তারা তাদের স্বামীর সম্পত্তি বুঝে পায়নি, সন্তান নামক নরাধমেরা মাকে ঠকিয়ে বাবার সম্পদ খেয়েছে, আর মাকে আজ এ ছেলের খুদ, কাল ঐ ছেলের কুড়ো খাইয়ে শেষ মেষ কবরও দিয়েছে। সালাম ভাই, মা শুধু না, আমি দেখেছি বোনের সম্পত্তি গুলো কিভাবে ভাই এরা মিথ্যা স্বাক্ষর দিয়ে জাল দলিল করে কেড়ে খেয়েছে।
সালাম ভাই, এ তো আমি গত ৮০/৮৫ বছরের যে ইতিহাস নিজে নাড়াচাড়া করলাম তা ই বল্লাম। শত শত বছর তো এইভাবেই আমাদের সমাজে নারীরা বঞ্চিত হয়েছে বাবা, ভাই বা ছেলেদের হাতে।
আমি বললামঃ ভাই, মুসলমানদের প্রথম দিকে নারীরা কিন্তু অনেক ধনী ছিলো। তাদের হাতে বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি, স্বামীর কাছে থেকে পাওয়া মোহর, ছেলেদের কাছ থেকে পাওয়া “নান ও নাফাক্বাহ” তথা খাওয়া দাওয়া ভোরণ পোষণ পেয়ে অনেক ধন সম্পত্তির অধিকারী হতো। আমি তাকালাম আলকায়রোয়ান ইউনিভার্সিটির দিকে, আলআযহার মাসজিদের দেয়ালে পাথরে, বৃটেইনের প্রথম মসজিদের মেহরাবে মিনারে, দেখলাম মুসলিম ও মুসলিম বিশ্বের সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে মুসলিম মেয়েদের সুন্দর হাতের স্নিগ্ধ ছোয়া কেমন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
ডক্টর বললেনঃ সালাম ভাই, এতো গেলো আমার দেখা ইতিহাসের কথা। আমার এক শিক্ষক দেখিয়েছেন গত ১৫০ বছরে উত্তর বংঙ্গে আমাদের জেলাতে কোন মেয়েই তার স্বামীর ওয়াদাকৃত মোহরের পরিপূর্ণ টাকাটা বুঝে পায়নি। যেটা ছিলো তাদের সতীত্বের হক, নারীত্বের পাওনা ও ইসলামের দেয়া বিশাল উপহার। পায়নি, সালাম ভাই, ওরা এগুলো বুঝে পায়নি, ওদের দেয়া হয়নি। অথচ স্বামীরা রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে বুকের পাটা উন্মুক্ত করে, অহংকারে মাথা উন্নত করে, লাজহীন অথবা দ্বীনহীনতার ধ্বজা উড়িয়ে। কেও ভাবেনি এটা ছিলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নারীদেরকে দেয়া একটা ফরজ আমানাত। আমানাতের এই খেয়ানাত করতে তাদের একটু ও বাঁধেনি।
আমি সত্যি ম্রীয়মান হলাম। আমি নিজেকে অসহায় মনে করলাম।
ডক্টর সাহেব এবার কথার স্বর নামিয়ে বললেনঃ ভাইজান, আমার হৃদয় ভেংঙ্গে খান খান হয়ে যায়। সেই ছোট বেলা এ পর্যন্ত কত শত মাহফিলে হুজুরদের সুন্দর মন কাড়া ওয়াজ শুনলাম। আধুনিক বিজ্ঞানের উগরে দেয়া সামাজিক মাধ্যমের পৃষ্ঠা সমূহে লক্ষ লক্ষ আর্টিকেলের সম্ভার স্রোতের মত চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখলাম। ইউটিউবের কল্যানে দেওবন্দী, সালাফী, তাবলীগী, জামাআতী, সুফী কিংবা নানান বর্ণের বক্তাদের বক্তৃতা দেখলাম ও শুনলাম। টুপির ব্যবহার নিয়ে কথা। ঈদ মুবারাক বলা, কুলাকুলি করা, চুলের বাবরি বা টেকো মাথা করা এই সব নিয়ে কুরআন হাদীসের দলীল নিয়ে চিৎকার করতে শুনলাম। অথচ আজকের দুনিয়ায় মুসলিম সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠি যে আজ এত বঞ্চনার শিকার, তাদের নিয়ে লেখা নেই, কথা নেই, আন্দোলন নেই, ট্রেইনিং নেই, নেই এই ব্যাপারে কোন জাগৃতি অথবা চিৎকার করা ওয়াজ।
আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম বিজ্ঞান মনষ্ক অথচ ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত এই তরুন অধ্যাপকের মুখের দিকে। তার কথা ক্ষুধা আমার মেরে দিয়েছে, মনে দিয়েছে বেদনার সঞ্চার।