নবীর (সা) নামে কুরবানী। শায়েখ ডঃ আব্দুস সালাম আজাদী।

ইদানিং কুরবানীর একটা ঝামেলা তৈরি হয়েছে। তা হলো কুরবানীতে গরুর ব্যবহার। হিদুস্তানে গরুর পূজনীয় হওয়ায় সমস্যা হয়েছে যেবা যারা গরু কুরবানী করতে চায় তাদেরকে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হয়। প্রথম যুদ্ধ হলো হিন্দু ও তাদের দোসরদের গোংরানি। আরকেটা হলো গরু কেনা বেচা, ও টাকা যোগাড়, গরুতে লাভের পরিমান নিয়ে “ফড়ে” বা গো-ব্যাবসায়ীদের লোভ লোকসানের ক্ষতিয়ান।

আমাদের নবী (সা) বিভিন্ন ধরণের পশু কুরবানী করেছেন। ভেড়া ও উটের কথা এসেছে। সেখানে গরু কম পাওয়া যেতো বলে তিনি হয়ত গরু কুরবানী করেন নি। তবে তিনি উট ও গরুর কথা বলে গেছেন। ইমাম মুসলিম বর্ণিত ১৩১৮ হাদীস ও ইমাম আবু দাউদের ২৮০৮ হাদীসদ্বয় দেখলে বুঝা যায় তিনি গরুতে সাতজন মিলে কুরবানী করার অনুমতি দিয়েছেন। আসলে এই অনুমতি হয়ে গেছে এখন অন্যরকম একটা ফিকহ। মনে রাখতে হবে আমাদের নবী (সা) যখন উট কুরবানী করেছেন, তখন একটাই একজনে দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেননি আমার মেয়ের পক্ষ থেকে একভাগ, আমার স্ত্রীর পক্ষ থেকে একভাগ, এই ভাবে সাতটা পুরণ করেই ছেড়েছেন। এটা কখনো হয়নি। বরং তিনি শেষ হজ্জে একাই এক শত কুরবানী করেছেন, যার তেষট্টিটা ছিলো নিজের হাতে, আর বাকি ৩৭টা তিনি আলী (রা) কে দিয়ে দেন কুরবানী করে ফেলতে। এ থেকে বুঝা যায় এক কুরবানী একা দেয়া ভালো, এমনকি একাধিক পশুও সম্ভব হলে, সামর্থ্য থাকলে দেয়া নবীর (সা) সুন্নাতের একটা।

এখন গোল বেঁধেছে এই এক গরুতে কতজন দিতে হবে এইটা নিয়ে। আমি মাওলানা খেতাব নেয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত গত আঠাশ বছরে গরু কুরবানী নিয়ে আমাকে হাজার হাজার মাসআলা জিগানোর কারণে গরুর নাড়ি নক্ষত্র জানতে হয়েছে। আমার কাছে কিছু ব্যপার বেশ কষ্টদায়ক মনে হয়েছে বলে হজ্জে এসেও মক্কার আযিযিয়ার এই হোটেলে বসে এখন গরুর আষাঢ়ে গল্প হোক বা না হোক, শ্রাবনীয় ধারার মত কিছু গল্প শেয়ার করতে হচ্ছে। আমাদের গরু কুরবানীর একটা বড় সমস্যা হলো শেয়ার নিয়ে, মনে করে হয় সাতটা শেয়ার দিতেই হবে। এই করতে যেয়ে ভালো মন্দ সব ধরণের লোক মিলে একটা কুরবানীর পশু কিনে কুরবানী দেয়। যাদের সাথে শেয়ার করলেন তাদের ব্যাপারটাও মাথায় রাখা দরকার। সবাই কি তাকওয়ার মানদণ্ডে আপনার মত?

এরপর আসে কুরবানীর সাথে অন্য কিছুর মেলানো। একবার আমাদের এলাকার এক কুরবানীর সাথে শুনলাম যুক্ত হচ্ছে কিছু আক্বীক্বার শেয়ার। চারটি কুরবানী ও তিনটি আক্বীক্বা। আমি তো তাজ্জব বনে গেলাম। আমি কার কার আক্বীক্বা জানতে চাইলে বলা হলো এক ছেলে ও এক মেয়ের আক্বীক্বা বাদ পড়ে আছে। তাদের টা এই সুযোগে দেয়া হবে। শুনলাম ওদের জন্ম দশ বছরের ও আগে। এক্ষেত্রে আমার মন ভালো লাগেনি। কারণ দুইটার উদ্দেশ্য দুই রকম। বাচ্চার জানের বদলে একটা পশু যবেহ করা হয় আক্বীক্বাতে। তা করতে হয় জন্মের ম্যাক্সিমাম ২১ দিনের মাথায়। আজ দশটা বছর গেলো আক্বীক্বা করা হলোনা!! এই ধরণের মানসিকতা আমার পছন্দ হয়নি। যদিও হানাফি মাযহাবে এটা করা জায়েয, কিন্তু মনের আবেগের সাথে কুরবানীর সম্পর্ক বজায় রাখা হয়েছে বলে মনে হয়নি।

তবে হ্যাঁ বাচ্চাও হয়েছে কুরবানীর একটু আগ দিয়ে সে ক্ষেত্রে যদি কেও কুরবানীর পশুর সাথে আক্বীক্বা মেলাতে চায়, তবে অধিকাংশ ইমাম ও উলামারা না করলেও আবু হানিফা ও তার অনুসারীরা একে জায়েয বলেছেন। আমার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উস্তায এটা করা যায় বলে মত দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেছিলেনঃ না করাই ভালো, এতে করে আক্বীক্বার স্পীরিট বজায় থাকেনা।

গরু কুরবানী করতে যেয়ে আরেকটা প্রসংগ ইদানিং চারিদিকে খুব বেশি ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তা হলো আমাদের নবী (সা) এর নামে কুরবানী করা। এটা একটা হাদীসের কারণে বেশি প্রসিদ্ধ। হাদীসটা তিরমিযী ও আবূ দাঊদ (রা) তাদের সুনানে বর্ণনা করেছেন। সাইয়িদুনা আলী (রা) সব সময় দুইটা কুরবানী করতেন। একটা নিজের পক্ষ থেকে, আরেকটা নবী (সা) এর পক্ষ থেকে। এই হাদীসটা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন, আমাদের শায়খ আলবানী সহ অনেক বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাদীস টাকে খুব দূর্বল মনে করেছেন। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, আমার নবী (সা) এর নামে কুরবানী দেয়ার দরকার নেই দুই কারণে। প্রথমতঃ তিনি উম্মাতের কাছ থেকে দুয়া চান, তার পক্ষ থেকে ইবাদাত তিনি চেয়ে যাননি। তিনি আরশের নিচে মাক্বামে মাহমূদ দেখে এবং এর অধিকারী তিনি হতে পারেন এ ব্যাপারে কিছুটা ইংগিত পেলেও তিনি প্রতিটি আযানের পর তাঁকে যেন ঐ স্থানে অধিষ্ঠিত করা হয় এই জন্য দুয়া করতে বলে গেছেন। তিনি নামাজের তাহিয়্যাতের সময় তার কাছে সালাম পাঠানো ও দুয়ার কথা মুখস্ত করিয়ে গেছেন। আমাদের রাব্ব আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ও আমাদের বলেছেনঃ তোমরা দুয়া করে বলোঃ “রাব্বানা ইন্নানা সামি’না মুনাদিয়ান ইয়ুনাদী লিল ঈমান, আন আমিনু বিরাব্বিকুম ফা আমান্না”। আমাদের রাব্ব, আমরা আহ্বানকারীর আহ্বান শুনেছি, যিনি আমাদের ডেকেছেন “তোমাদের রাব্বের উপর আনো” বলে, আর তাই আমরা ঈমান এনিছি”। এই যে “আহ্বানকারী” বলা হলো, তাদের একজন তো আমাদের নবী (সা)। এইভাবে আমাদের নবীর (সা) এর নামে সালাত, সালাম, দুয়া ও ইত্তিবা’ আমাদের জন্য ফরয করা হয়েছে। তাঁর পক্ষ থেকে নামায পড়া, যাকাত দেয়া, হাজ্জ করা, সিয়াম পালন করা, কিংবা কুরবানী করা না আমাদের উপর ফরয করা হয়েছে, না আমাদের কাছে চাওয়া হয়েছে। সাইয়্যিদুনা আলী (রা) এর কাজ টাকে আমরা একদিক দিয়ে দুর্বল হাদিসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। যদি হাদীস সাহীহ ও হয়, তাহলে হতে পারে তিনি এটা করেছেন পরিবারের সদস্য হিসেবে, বা হতে পারে আমাদের নবী (সা) তাঁক অসিয়্যাত সে হিসেবে করেছেন। তা না হলে এটা যদি সবার জন্য হতো, হয়ত অনেক সাহাবীদের এই কাজ করতে দেখতাম। কিন্তু কেও তো করেনি, তাহলে আমাদের মুহাব্বাত কি তাদের চেয়েও বেশি হলো? যাহোক, জায়েয না জায়েযের বিতর্কে না জড়িয়ে আমি শুধু মনে করি আমাদের নবীর (সা) নামে কুরবানী করার চেয়ে আমাদের পরিবারের জীবিত সদস্যদের পক্ষ থেকে করা বা এমনকি মৃত আত্মীয় স্বজনদের পক্ষ থেকে দেয়ায় তাদের বেশি উপকার হবে। আমাদের নবী (সা) ছিলেন মা’সূম, কোন গুনাহ তাঁর জীবনে ছিলোনা, তাহলে তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী না দিলেও চলে।

এই ক্ষেত্রে সব চেয়ে খারাপ যে কথাটা আমি শুনে কেঁপে উঠি, তাহলোঃ “হুজুর, আমি আমাদের নবীর (সা) নামে কুরবানী করতে চাই”। আমি কেঁপে উঠি, শিরকের গন্ধ পাই এবং শব্দের ভীতিতে ক্রন্দন করি। কুরবানী হতে হবে আল্লাহর নামে, বিসমিকাল্লাহু আকবর, “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার”। এর মাঝে “বিসমি মুহাম্মাদ” শুনলে সুস্পষ্ট শিরকের লাভা আমার কানে জ্বলে ওঠে। মাঝে মাঝে টিভি স্টেজেই আমি চিৎকার করতাম, “বলতাম, আফা অথবা ভাইয়া, আফনে কথাটা শুদ্ধ করেন, বলেন আমাদের নবীর (সা) পক্ষ থেকে কুরবানী দেবো, নবীর (সা) নামে না”।

নবীর (সা) নামে কুরবানী। শায়েখ ডঃ আব্দুস সালাম আজাদী।

About The Author
-

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>