আল্লাহ, তার দ্বীন ও দ্বীনের সংশ্লিষ্ট সকল কিছুর প্রতি কাউকে আকৃষ্ট করার নিমিত্তে ডাকা ও আহবান করাকে আমরা দ্বীনের দাওয়াত হিসাবে বুঝি। এই আহবানের অনেক দিক ও প্রেষনা আছে। এই আহবানের আছে অনেক শৈল্পিক পদ্ধতি ও সৃজনশীল উপস্থাপনা।
দ্বীনের দাওয়াতের কাজ সকল মুসলমানের ওপর ফরজ। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান ও সুযোগ অনুযায়ী আল্লাহর দ্বীনের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব সকল মুসলমানের ওপর। তবে, সবাইকে সকল স্থানে ও পরিবেশে সব কথা বলতে হবে বা সবাইকে সমানভাবে স্বার্থক ভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন, তা কিন্তু ঠিক নয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিতঃ একবার প্রাচ্য থেকে দুইজন লোক এসে মদীনাতে বক্তৃতা দিলে লোকজন খুব বিস্মিত হয়ে যান। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কিছু কথা আছে তা যেন এক যাদু (বুখারীঃ ৫৭৬৭)।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, যারা বক্তৃতার মাধ্যমে দাওয়াতী কাজ করেন তাদের কথা, বাচনভংগী, শব্দ চয়ন, কন্ঠ ও উপস্থাপনার এমন আকর্ষনীয় কিছু থাকতে হবে যাতে তা শুনলেই মানুষ এক ধরণের তন্ময়তার মধ্যে ডুবে যাবেন এবং আমন একটা আবেগপূর্ণ আবহ তৈরী হবে যার মাধ্যমে শ্রোতারা আত্মনিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলবেন। অন্যদেরকে এমনভাবে আকৃষ্ট করাটা নিশ্চয় একটা চমৎকার শিল্পিত কাজ। আর আমরা জানি যে কোন শিল্পের জন্যে একটা প্রতিভা থাকতে হয়। এরপর সেই প্রতিভার চর্চা করতে হয়। আর যে কোন চর্চা ও প্রশিক্ষণের জন্যে একজন শিক্ষক বা প্রশিক্ষকের কাছে যেতে হয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে আল্লাহ নিজে শিক্ষা দিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে ও উপায়ে তাকে জিব্রাঈল (আঃ) পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর দাওয়াতী কাজে ছিলেন একজন চৌকস শিল্পীর মত, যার কথা শুনে, যার চেহারার দিকে তাকিয়ে কিংবা তাঁর বাচন ভংগী দেখেও শ্রোতা-দর্শকরা বিমোহিত হয়ে যেতেন।
বক্তৃতা সংস্কৃতিঃ
জনসভায় ওয়াজ করা বা ভাষন দেওয়া। একেক দেশের একেক এলাকায় একেক রকমের স্বীকৃত শিল্প বা কারুকাজ আছে। আমি একবার ইতালীর মিলানোতে এক মসজিদের ওয়াজ মাহফিলে প্রধান বক্তা হিসাবে বেশ সরস বক্তৃতা দেওয়ার পরও আয়োজককদের একজন বলেছিলেন- শায়খ, আপনার বক্তৃতা সুন্দর হয়েছে। তবে, আমাদের শ্রোতা টেনে টেনে সুর দেওয়াকে বেশী পছন্দ করেন। ফলে, এই মসজিদে আমাকে দ্বিতীয়বার যে আর প্রধান বক্তা হিসাবে ডাকবে না, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ তাদের শিল্পের সংগার সাথে আমার বক্তৃতা শিল্পের সংগার মিল হয়নি এখানে। যদিও দাওয়াতী বক্তৃতা শিল্পের কিছু মৌলিক গুণাবলী আছে, কিন্তু এর পরও কিছু আঞ্চলিক চাহিদা ও রুচি থাকে। সেটা জেনে-বুঝে স্থানীয় শ্রোতাদের চাহিদার প্রতি সম্মান রেখে নিজের সংগাটাকে একটু সংগ্রহন করে নেওয়াটাই শিল্পের দাবী। যারা কবিতা শুনতে পছন্দ করেন, সে বক্তৃতায় কিছু কবিতার সুর ও দ্যোতনা মিশ্রিত করাই শিল্পের দাবী। এটাকে বলে শিল্পের ফর্ম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) এর যুগেও যে সব ইসলামী কবিরা ইসলামসিদ্ধ কবিতা লিখতেন তাঁরা কিন্তু সেই জাহেলিয়াতের কবিতার ফর্মকে অনুসরণ করেছেন। কবিতার শুরুতে আগে প্রেমিকার প্রশংসা করতে হতো। যাকে বলে মুকাদ্দিমা তালালিয়া। কবি যুহাইর বিন আবি সুলমা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) কে উদ্দেশ্য করে ৬০ লাইনের একটা কবিতা বলেন। যা শুনে তিনি নিজের গায়ের চাদর যুহাইর (রা) কে দিয়ে দেন। অথচ কবি প্রথম লাইন থেকেই কল্পিত প্রেমিকা সু’আদের প্রশংসা করছেন ৩৮ লাইন ধরে। আর ধৈর্য্য সহকারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) তা শুনেছেন। কারণ এটাই ছিলো তখন কবিতার স্বীকৃত ফর্ম।
আমি এই কথা লেখার সময় বাংলাদেশের একজন তরুণ আলিম ও বক্তার ফেইসবুকে খুব কৌতুহলী একটা স্ট্যাটাস পেলাম। সেটা আপনাদের জন্যে হুবহু এখানে কপি করছি এই কারণে যে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শিল্পীরাও নিজেদেরকে কিভাবে স্থানীয় শিল্পের সাথে মানিয়ে চলেন বা চলতে হয়।
“আমার যদি একটা ভালো সুর থাকতো তাহলে আমি আজ যুবকদের আইকন হতে পারতাম, দ্বিতীয় সাঈদী হতে পারতাম। শুধু সুর না থাকার কারণে আমার আগে পিছে কোনো উপাধি নাই। এই পর্যন্ত যারাই দ্বিতীয় সাঈদী হয়েছেন কিংবা ইয়ং জেনারেশনের মডেল হয়েছেন সুর দিয়েই হয়েছেন । ইলিম দিয়ে দ্বিতীয় সাঈদী হওয়া যায় না, আইকনও বনা যায় না। আল্লামা সাঈদীর মত একজন বড়ো মাপের আলেম সৈয়দ কামাল উদ্দিন জাফরি কিন্তু সুর না থাকার কারণে তিনি সাঈদী হতে পারেননি, জাফরীই থেকেছেন। ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের সুর না থাকার কারনে সাঈদী হওয়া তো দূরের কথা আলিমই হতে পারেননি, স্যারই থেকেছেন। মুফতি আর মুহাদ্দিস হওয়া তো অনেক পরের কথা।
,
অনেক কষ্ট নিয়ে বলছি কথাগুলো। কেউ মনে করবেন না যে, আমি সুরের বিরুদ্ধে কথা বলছি; জী না । সুর দিয়ে ওয়াজ করা যেতেই পারে কিন্তু সূরের সাথে যে ইলিমও প্রয়োজন সেটা আজকে আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। আজ বাংলাদেশের এক বিখ্যাত মুফতির ১২ মিনিটের একটা বক্তব্য শুনলাম। সেখানে তিনি দুইটা ফতোয়া দিয়েছেন, দুইটা ফতওয়াই ভুল। এই পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে আমি বেশ কয়েকটা ফতওয়া শুনেছি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ পর্যন্ত একটা ফতওয়াও সঠিক পাইনি। শ্রদ্ধেয় Omar Faruque একদিন আমাকে বললেন, এই বিখ্যাত মুফতির কাছ থেকে জীবনে একটা ফতওয়া শুনছিলাম, আর সেটাই ভুল।
বড়ই কষ্ট লাগে রে ভাই বড়ই কষ্ট লাগে এই রকম আজগুবি ফতওয়া শুনলে। এই জনপ্রিয় মুফতিকে আমি অবশ্যই ভালোবাসি। আল্লাহর কসম তাঁর প্রতি আমার সামান্যতম কোন হিংসা বিদ্বেষ নাই কিন্তু এই রকম ভুল ফতোয়া কি সংশোধনের প্রয়োজন না? এখন তাদের ভুল ফতোয়া নিয়ে পর্যালোচনা করলে বলে সুর নাই বলে হিংসা করতেছি। একবার একটা বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করে মাপ পেয়ে গেছি যে, মানুষ কতটুকু অন্ধ ভক্ত। তাই এখন পর্যালোচনা বাদ দিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে সুর বানানোর প্র্যাকটিস করতেছি”
সেমিনারীয় আলোচনাঃ
যেখানে ময়দানিক জনসভা না হয়ে একাডেমিক দাওয়াহ, আলোচনা বা বিতর্ক হয়, সেখানে সুর দিয়ে আলোচনা করাটা নিছক হাস্যকর। আপনি দেখবেন- আমাদের দেশের বিখ্যাত ময়দানী বক্তারা যখন সংসদে বক্তব্য দেন তখন তাঁরা কিন্তু সুর দিয়ে কথা বলেন না। তাঁরা ঠিকই একজন জাদরেল পার্লামেন্টারিয়ানের মতই কথা বলেন। এটাই হলো ‘দাওয়াহ’র শিল্পবোধ। স্থান, শ্রোতা ও সময়ের উপযোগী করে আমার বাণী ও মেসেজটা সুন্দর ও আকর্ষনীয় করে উপস্থাপন করাটাই হলো ‘শিল্পিত দাওয়াহ’। যিনি ময়দানী বক্তা, তাকে ধরে এনে পার্লামেন্টে অথবা সেমিনার হলে বসিয়ে দিলে তিনি এলোমেলো হয়ে যেতে পারেন। মেহেদী হাসান বৃটেনের একজন বিশ্ববিখ্যাত টিভি সাংবাদিক ও তার্কিক, যার কথা শোনার জন্যে হাজার হাজার শিক্ষিতরা টিকেটও কাটেন। কিন্তু তাকে যদি প্যারেড ময়দানের ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করতে দেন, তাহলে অর্ধেক শ্রোতা হয়ত ঘুমাবেন অথবা চা খাওয়ার জন্যে উঠে চলে যাবেন।
আস্তিক ও নাস্তিকদের বিতর্কে বর্তমান দুনিয়ায় যারা বিখ্যাত তাদের একজন হলেন প্রফেসর উইলিয়াম ক্রেইগ (William Lane Craig) । তিনি যখন লেকচার থিয়েটারে আলোচনা করেন আমি তন্ময় হয়ে শুনি। কিন্তু তিনি যদি এইভাবে আপনাদের সামনে মুক্ত আকাশের নিচে আলোচনা করেন তখন লোকেরা আবার তন্ময় হয়ে গভীর নিদ্রায় অবগাহন করবেন।
বাংলাদেশের এক তরূণ জনপ্রিয় বক্তাকে দেখি ওয়াজে আযান দিচ্ছেন, গান গাচ্ছেন, চিল্লাছেন, কবিতা পড়ছেন, তেলাওয়াত করছেন। আর মানুষ ‘পোকার’ মত শুনছেন। আমার বিলেতী ছাত্রদেরকে তা শুনালে এঁরা তো অবাক। আমাকে বলে- উস্তাদ, এই শায়খ কি রাগী? আমি বললাম- কেনো? তখন বলল- উনি অত চিল্লাছেন কেন?
‘দাওয়াহ শিল্পে’র প্রশিক্ষণ ও চর্চাঃ
দ্বীনি বক্তব্যের সুন্দর প্রকাশনই ‘দাওয়াহ শিল্প’। এর জন্যে কিছু মেধা তো থাকতেই হয়- থাকতে হয় সৃজনশীলতা। তবে, এ জন্যে প্রশিক্ষনটাও খুবই দরকার। শিল্পের প্রশিক্ষণ হয় দুইভাবে- বাস্তব প্রশিক্ষকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে অথবা সফল শিল্পীদের উপস্থাপনা দেখে ও শুনে। যারা যত বড় লেখক, তাঁরা তত বড় পাঠক। ঠিক তেমনি, যারা যত বড় বক্তা তাঁরা তত বড় শ্রোতাও। আপনি ভালো বক্তা হতে চাইলে ভালো বক্তাদের বক্তৃতা আপনাকে বেশী করে শুনতে হবে। একবার শায়খ তারেক মনোয়ার ভাইয়ের সাথে কোন এক দাওয়াতে দেখা। কথা বার্তার এক ফাকে তিনি বললেন- কালাম, আমি কিন্তু তোমাদের আলোচনা শুনি। আমি তো অবাক। বললাম- বলেন কি? আমার মত অখ্যাত লোকের আলোচনা আপনি শুনে সময় নষ্ট করেন? তিনি বললেন- আমি সবার বয়ান শোনার চেষ্টা করি কারণ আমি অন্যদের কাছ থেকে শিখি। এতে উনার মত বক্তার পরম বিনয় প্রকাশ পেলেও ‘দাওয়াহ শিল্প’ প্রতিনিয়ত উন্নত করতে গেলে এভাবেই যে সব সময় প্রশিক্ষণ নিতে হয়, শায়খ তারেক মনোয়ার সে কথাই বুঝালেন।
আমি এখন হয়ত হাজার হাজার শ্রোতা সামনে থাকলেও কথা বলতে সংকোচ বোধ করি না, কিন্তু এই ‘আমি’ এক সময় গ্রামের ছোট মসজিদে আযান দিতেও ভয় পেতাম। কিন্তু সেই আমি এখন লাখো জনতার সামনে কথা বলতে কোন ভয় পাই না। বরং শ্রোতা যত বেশী হয়, কথা বলার প্রেরণাও তত বেড়ে যায়।
অবশ্য আমি ভালো করেই জানি, আমি একজন ভালো বক্তা নই। তাই আমি যত বলি, তাঁর চেয়ে শুনি বেশী। আমি বুঝি, একজন ফুটবলার যতই বিশ্ববিখ্যাত হোন না কেন তিনি যেমন দৈনিক চর্চা করেন ও কোচের কাছে প্রশিক্ষণ নেন, যারা দাওয়াহ শিল্পের কর্মী, তারাও প্রতিনিয়ত চর্চা করা দরকার ও প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার।
আমি আমার ল্যাপ্টপে কাজ করি বা খাওয়ার সময় আমি বিভিন্ন দেশের ও ভাষার বক্তাদের আলোচনা শুনি। সত্যি, আমি যখন শুনি তখন মনে হয়, আমি যেন একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদেরকে ফান্নুল খাতাবাহ বা বক্তৃতা শিল্পের ওপর এক বছরের ওপর একটা কোর্স পড়তে হয়েছে। এতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। তবে, মনে হয়েছে যে নিজের বক্তৃতার মানকে সঠিক দাওয়াতী কাজে লাগাতে গেলে অনেক বেশী সৃজনশীল হতে হয়। আল্লাহর সাহায্য চাইতে হয় বারবার। মাওলার সাহায্য ছাড়া মুখ থেকে হৃদয়ছোয়া কথা মুখ থেকে বের হয় না।
যারা যে বিষয়ে পারদর্শী তারা দে বিষয়ে বেশী ফোকাস দেওয়া উচিত। ডঃ যাকির নায়েক তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে অদ্বিতীয়। তিনি যখন মুফতির ভূমিকায় আসেন তখন তিনি তেমন পারদর্শীতা দেখাতে পারেন না।
দাওয়াহ কাজের আরেকটা দিক হলো ব্যক্তিগত উপস্থাপনা। আমি এক মহাবিখ্যাত বক্তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাথে। বিশ্বাস করুন, এই বক্তা আমাদের সাথে কথা বলার সময় দৈনিক পেপার পড়ছিলেন আর আমাদের সাথে শুধু হু হা করছিলেন।
তথচ পাকিস্তানের শায়খ তারিক জামিলের ব্যক্তিগত উপস্থাপনা দেখুন। তিনি যখন কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলেন মনে হয় তাঁর কত আপনজন তিনি। উনার কথা শুনলে আমারও পরান জুড়িয়ে যায়- ভালোবাসায় ভরা মধুর মুচকি হাসিতে কি যে আবেগ, কি দরদ মাখা শব্দ!! দাওয়াহ শিল্পে এটা একটা অসাধারণ উদাহরণ। আপনি যদি দাঈ মুসয়াব ইবনে উমায়েরের গল্প পড়েন- কিভাবে তিনি মদীনাতে প্রথমযুগে দাওয়াতী কাজ করেছিলেন, দেখবেন এখানে এই ব্যক্তিগত দাওয়াহ ও উপস্থাপনা ছিলো খুবই প্রভাবশালী।
ভালোবক্তারা নিজেরা নিজের মত করে চর্চা করেন। আয়নার সামনে একা একা দাঁড়িয়ে আয়নাকে জনসমুদ্র মনে করে মন খুলে বলার চর্চা করাও বক্তাদের কাছে শোনা যায়। তবে, সবাইকে একটা আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে এই মর্মে যে- আমি একজন মুসলিম; দাওয়াতী কাজ করা যার ওপর ফরজ। আল্লাহ আমাকে যতটুকু যোগ্যতা দিয়েছে সেটা আমাকে কাজে লাগাতে হবে এবং যে কোনভাবেই হোক আমাকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাকে এ জন্যে চর্চা করতে হবে। দাওয়াহ মানে শুধু লেখা ও বক্তৃতা দেওয়া নয়। আরো অনেক উপায় আছে যা দিয়ে দাওয়াতী কাজ করা যায়। তবে, সেটা হতে হবে শিল্পিত। আর শিল্প মানেই চর্চা করা। আর চর্চা মানেই একজন কোচ বা প্রশিক্ষকের তত্ত্ববধানে থাকা।
পেশা হিসাবে দাওয়াহঃ
ইসলামের বহু কাজ আছে পেশা হিসাবে নেওয়া যায়। পেশা বলতে বুঝাচ্ছি সেটা হবে তাঁর নেশা ও দক্ষতা এবং এটাকেই তিনি তাঁর জীবন ও জীবিকার মাধ্যম হিসাবে বেছে নেন।
প্রশ্ন হলো- দাওয়াহ যদি ব্যক্তিগত ফরজ কাজ হয়, এটাকে রুটি-রোযগারের মাধ্যম হিসাবে নিয়ে সেখান থেকে বেতন নেওয়া ঠিক হবে কি? আমি এই রচনায় ফতোয়ামুলক আলোচনা করব না। কিন্তু এর নৈতিকভিত্তিটা একটু বুঝার চেষ্টা করব।
সালাত করা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ফরয। কেউ কি বলতে পারবেন যে আমি সালাতকে পেশা হিসাবে নিয়েছি? নিজে নিজে সালাত করে কেউ কি কারো কাছ থেকে বেতন নিতে পারবেন? পারবেন না। এটা অনৈতিক। কিন্তু সালাতের ইমামতি করে বেতন নেওয়া যায় বলে উম্মাত এজমা (একমত) করেছে।
দাওয়াহ অবশ্যই একটা ব্যক্তিগত ফরজ কাজ। সবাইকে এই ফরজ দায়িত্ব আল্লাহ দিয়েছেন। ফলে, এটাকে মৌলিকভাবে একটা পেশা বা জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হিসাবে নেওয়ার নৈতিক ভিত্তি নেই। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্বের বাইরের রাষ্ট্র যদি কাউকে দায়িত্ব দেন সেখানে রাষ্ট্রের দেওয়া দায়িত্ব পালনার্থে রাষ্ট্রের দেওয়া বেতন নেওয়াটা নৈতিক। যেখানে রাষ্ট্র কাউকে এভাবে দাওয়াহ কাজে দায়িত্ব না দেয়, সেখানে অন্য কোন দল, সংস্থা বা সংগঠন এই দায়িত্ব দিতে পারেন এবং সেখানে কোন মুসলমান এটাকে পেশা বা চাকুরি হিসাবে নিতে পারেন। তবে, এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের দাওয়াতের কাজ কিন্তু যথাযথভাবে আগের মতই বহাল থাকবে।
দাওয়াহ কাজে কোন ধরণের অর্থনৈতিক চুক্তি করে যাওয়া বা এটাকে পরিপূর্ণ বানিজ্যিক প্রোডাক্ট হিসাবে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। দূর-দূরান্তে থেকে আগত দাঈ যারা আছেন তাদের যাতায়াত খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচ যদি কেউ বহন করতে চান সেটা নেওয়া যায়। এরপর যদি কেউ নিজেদের ইচ্ছায় সন্তুষ্ট চিত্তে কোন উপহার দেন সেটাও নেওয়া যায়। কিন্তু শর্তারোপ করে, রেইট ঠিক করে দাওয়াহকে একটা বানিজ্যিকভাবে নেওয়া আমার মনে হয় একেবারেই অনৈতিক। এভাবে দাওয়াহ কাজ করলে সেখানে হেদায়েতের আলো পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। মানুষ আপনার লেখা ও কথাওকে হয়ত পছন্দ করবে, কিন্তু আপনার কাছ থেকে হেদায়েত পাবেন না। রোমান্টিক লেখা পড়েও তো লোকে আনন্দ পান, কিন্তু সেখানে কি হেদায়েত আছে?
লেখা-লেখির কাজ করে টাকা নিয়েও দাওয়াতী কাজ করা যায় না। আমরা লিখব আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) এর দেখানো পথ ও মত প্রচার ও প্রসারের জন্যে। নিজে লেখক হিসাবে পরিচিত হওয়া বা এর মাধ্যমে বাণিজ্য করে টাকা পয়সা ইনকামের নিয়ত যেন না থাকে। লেখালেখির সময় মনে রাখতে হবে প্রতিটা লিখিত শব্দ আমাদের পক্ষে বা বিপক্ষে যাবে। আমাদের নিজের হাতে লেখা শব্দমালাগুলো যেন আমাদের ভুল নিয়তের কারণে আমাদেরকে দুনিয়া ও জাহান্নামের অপমানের দিকে ঠেলে না নিয়ে যায়।
আমাদের দাওয়াতী কাজের উদ্দেশ্য হলো মানুষদেরকে নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর দিকে নিয়ে আসা। দাঈ’র ভক্ত ও পাঠকবৃদ্ধির চেষ্টা ও উদ্দেশ্য না করে আল্লাহর ভক্ত তৈরী করাই দাওয়ার উদ্দেশ্য। দাওয়াহ’র ফোকাস যদি আল্লাহ থেকে সরে দাঈ নিজে ও তাঁর নিজের পেশা ও বানিজ্যিক পর্যায়ে চলে যায়, সেটা হবে আত্মবিধ্বংসী ও জাহান্নামে যাওয়ার পথ। এই ধরণের দাওয়াতের মাধ্যমে বিনোদন হয়, হেদায়েত হয় না। এর মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান তৈরী না হয়ে তৈরী হয় হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা। দাওয়াহ হবে আমাদের সবার জান্নাতে যাওয়ার বাণিজ্য, দুনিয়ার গাড়ী-বাড়ি ও ব্যাংক ব্যালেন্সের ব্যবসা নয়। যারা মাল-সম্পদের ভালোবাসায় দাওয়াহকে বাণিজ্যে পরিণত করেন, তারা সাময়িক খ্যাতি পেলেও মনের গভীরের শান্তি ও মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও সম্মান থেকে বঞ্চিত হন।
আমাদের মনে রাখতে হবে- দাওয়াহ হবে শিল্প, দাওয়া হবে আমাদের নেশা এবং জান্নাতে যাওয়ার জন্যে একটা অবৈতনিক পেশা। এটি যেন কোন ক্রমেই দুনিয়া ও জাহান্নামে যাওয়ার কারণ ও মাধ্যম না হয়।