বাংলাদেশের ইসলামি জাগরণের কথা ইদানিং খুব বলি। বলি, ইসলামের কোন ভয় নেই বাংলাদেশে। বলি, ইসলাম কে কেও মিটায়ে দিতে পারবেনা ঐ ভূখন্ড থেকে। বলি, বাংলাদেশ থেকে ইসলাম মুছে ফেলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটা জাগৃতি বন্যার বেগে ধেয়ে আসছেই। যখন এই সব কথা প্রগলভতার সাথে বলি, যে মুখটা এসে আমার সামনে এক ফালি চাঁদের হাসি বিকীর্ণ করে, ‘সালাম ভাই, ক্যামন আছেন’ বলে আশা যোগায় তিনি হলেন ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগির।
তাকে দেখে আমি এত কঠিন কথা বলতে সাহস পেতাম। ১৯৮৯ সাল থেকে পরিচয়। তখন তিনি রিয়াদের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এর মাস্টার্স এর ছাত্র। ‘মাশারিকুল আনওয়ার’ নামক এক হাদীস গ্রন্থের উপর তিনি ভাষাতাত্বিক স্টাডী করছেন। জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে বোকা বোকা ভাষায় বল্লাম, হাদীসের কেতাব, স্টাডী হচ্ছে ভাষাতাত্বিক?! তিনি হেসে বললেনঃ ‘সালাম ভাই, এই যায়গায় তো উম্মাতের সমস্যা। আজকের মুহাদ্দিস রা ভাষা জানেনা, আর ভাষাবিদ রা হাদীস জানেনা’। চোখ খুলে গেল। ইবনে মালিকের দর্শন তিনি বুঝালেন। হাদীস কে কিভাবে যে ইগনোর করা হচ্ছে তা বুঝালেন। আমি আপ্লুত হলাম, চোখে মদীনার সবুজ গম্বুজের হাতছানি খেলতে লাগলো। দেখা হয়েছে বহু বার, বহু যায়গায়, বহু ক্ষেত্রে কিংবা বহু আনন্দে বিপদে। একবার রিয়াদে বাংলাদেশী দায়ী ইলাল্লাহ গণের মাঝে মারাত্মক এক ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ডঃ তরিক, মাওলানা সাঈদ মিসবাহ, মাওলানা আব্দুর রাক্বীব সহ বেশ কয়েকজন আলিমের মাঝে একটু দুরত্ব তৈরি হয়। জাহাংগির ভাই তখন ছাত্র, কাজ করেন বাংলাদেশ এম্বেসীতে, এবং দাওয়াতি এক সংস্থার সাথে।
সেদিন মিমাংসার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিলো এমন যে তার প্রতিটা কথা সবাই মেনে নেন, এবং সকলের মন শান্তিতে ভরে ওঠে। আমি উনাকে বললামঃ ভাইজান, হামযাতুল ওয়াসল এর মত কাজ করলেন, আগের ও পরের শব্দের সাথে নিজকে বিলিয়ে কিভাবে মিলিয়ে দিলেন। উনি আবারো উপহার দিলেন একফালি হাসি। ১৯৯১ সালে মদীনায় যাচ্ছি কিং সাঊদ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে। তিনি খুশী হয়েছিলেন। কিং সাঊদের ইসলামিক স্টাডীজ তার পছন্দ ছিলোনা। তিনি তখন পিএইচ ডি থিসিস শুরু করেছেন। বিদেশিদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত ছড়াতেন। ইংরেজিতে তিনি খুব ভালো ছিলেন বলে আমেরিকান সেনা ছাওনিতে তিনি ইসলাম পৌঁছানোর কাজ করতেন। জিজ্ঞাসা করলামঃ ভাই, কয় জন ইসলাম কবুল করেছেন? তিনি বললেনঃ বলা নিষেধ, তবে আপনাকে একটা কথা বলি, ওদের মাঝে ইসলাম পৌঁছাতে পারলে তারা উন্মুখ হয়ে আছে। ঐ বছরেই শুনেছিলাম ডঃ জগলুল নাজ্জার ও জাহাংগির ভাইদের দাওয়াতে তিন শতাধিক সৈন্য মুসলিম হয়ে যায়। এবং সরকারি হস্তক্ষেপে এই দাওয়াতি কাজ বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৫ সালে মদীনা থেকে রিয়াদে বেড়াতে আসি। শায়খ আব্দুর রহমান মাদানী আর আমি। উদ্দেশ্য এম এ করার জন্য একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা। তিনি দাওয়াত দিলেন। ভাবী কে দেশে পাঠায়েছেন। শ্যালক আছেন বাসায়। বাসায় যেয়ে দেখলাম সব খালি। মানে উনার পি এইচ ডি শেষ, তিনি দেশে ফিরবেন। সার্টিফিকেট নিয়ে ও শ্যালকের পরীক্ষা শেষ করিয়ে ফিরবেন।
তিনি আমাদের জামিয়াতুল ইমামে নিয়ে গেলেন। শিক্ষক গণের সাথে পরিচয় করালেন। দেখলাম তার শিক্ষকগণ শুধু ভালোবাসেন না তাকে, সম্মান ও করেন ঢের। ঈমানের সাথে ইলম, ইলমের সাথে আমল এবং আমলের সাথে এত হিলম আমি আর কারো মাঝে পাইনি। তিনি সবার সাথে মিশতে পারার এক দূর্লভ গুণ অর্জন করে ছিলেন। তবে সহীহ হাদীসের এক চুল দূরে যেতে ছিলো তার প্রচন্ড আপত্তি।
“ভাই, জামাআতে ইসলামির সাথে বা তাব্লীগের সাথে, বা কোন অর্গানাইজেশনের সাথে থেকে কাজ করলে কি বেশি ভালো হত না”? আমার এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ “সালাম ভাই, বাংলাদেশে ৯০% মুসলিম, এদের মাঝে দল করা মানে এদের কে বিভক্ত করে ফেলা। বাংলাদেশের সব মুসলমানের সাথেই আমি থাকি, সে ভালো”। আমি বললামঃ “কিন্তু কেও তো আপনাকে মেনে নেবে না, তাছাড়া, কারো না কারো সাথে থাকলে একটু সাহায্য পাবেন”। তিনি বললেনঃ ” সবাই মেনে নেবে সালাম ভাই। কারণ কলেমার দাওয়াত এমন যে, ঐটা ব্যাবহার করে দেখেন না একজন ভিক্ষুক ও সব মুসলমানদের দয়া ও সাহায্য পায়। আমি না হয় “ঐক্যের ভিক্ষুক” হই। কলেমা নিয়ে সবার কাছে যাই, তাড়ায়ে দিলেও মারতে পারবেনা কেও। চোখ খুলে দিলেন আমাকে।
জাহাংগির ভাই, বড় অবেলায় চলে গেলেন, বিদ্যুতের যে আলোকচ্ছটা আপনি ছড়িয়ে ছিলেন তা বিকশিত না হতেই এই হতভাগা জাতিকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। আমি আপনার জন্য কী আর দেব। দুচোখের নহরে ভাসা জীর্ণ মলিন মুখ দেখুন, আর রোগাক্রান্ত হৃদয়ের দীর্ণ করা হাহাকার টাই শুনুন………… আল্লাহুম্মা নাক্কিহি মিনায যুনূব কামা য়্যুনাক্ক্বা আসসাওবুল আবয়াদু মিনাদ্দানাস।
ও আল্লাহ, তুমি তাকে জান্নাতুল ফিরদাওসের মেহমান বানাও। শাহাদাতের মর্যাদা দাও।