একটা প্রশ্ন গত ক’দিন অনেক ঘুরে ফিরে আসছে। তা হলো জরুরি এই কোভিড১৯ এর সময়ে মসজিদ তো খোলা হবে না মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি কি করবো? আমি বহু বছর থেকে ই’তিকাফ করে আসতেছি। আমি এবারো ই’তিকাফ করার নিয়্যত করেছি আমার “মাসজিদুল বায়তে” মানে ঘরের যে নির্ধারিত স্থানে আমি নিয়মিত সালাত আদায় করি, সেখানে। এটা কি ই’তিকাফ হিসেবে গণ্য হবে?
এইব্যাপারে আমার মতামত হলোঃ
১- আল্লাহ আমাদেরকে ই’তিকাফের যে শরঈ ধারণা দিয়েছেন, তা হলো মসজিদে হতে হবে। বাক্বারার ১৮৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই কথাই বলেছেন, তোমরা রাতে স্ত্রী সম্ভোগ করোনা, মসজিদে ইতিকাফে থাকা অবস্থায়। আল্লাহ ইব্রাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ) কে কা’বাহ ঘরকে পবিত্র করতে বলেছিলেন তাওয়াফকারী ও ইতিকাফকারীদের জন্য। এইছাড়া ইবন আব্বাসের একটা ফাতওয়াও আছে এমন ধরণের। একবার তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, একজন মহিলা মান্নত করেছে যা সে তার ঘরে সালাতের জন্য নির্দিষ্ট “মাসজিদুল বায়তে” ইতিকাফ করতে পারবে কিনা? তিনি বলেছিলেনঃ
بِدْعَةٌ وَأَبْغَضُ الأَعْمَالِ إلَى اللَّهِ الْبِدَعُ
অর্থাৎ এটা বিদআহ, আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ হলো বিদআহ তথা নতুন বানানো ইবাদাত। (বায়হাক্বী, সুনান কুবরা, ৪/৩১৬)। আমাদের নবী (সা) এর জীবদ্দশায় মসজিদের বাইরে তিনি ইতিকাফ করেননি। স্ত্রীদের কাওকে তার সাথে মসজিদে ইতিকাফ করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাওকে ঘরে ইতিকাফের অনুমতি দেন নি। এমনকি তাঁর ইন্তিক্বালের পরে উম্মাহাতুল মুমিনিন ইতিকাফ করতে চাইলে মসজিদেই করতেন। ঘরে করেননি তারা। এই সব গুলো মাথায় রেখে ইমাম কুরতুবি (রহ) উল্লেখ করেছেনঃ
أجمع العلماء على أن الاعتكاف لا يكون إلا في المسجد
অর্থাৎ আলিমগণ একমত হয়েছেন যে, মসজিদে ছাড়া ইতিকাফ হবেনা। (তাফসীর, ২/৩৩৩)। এই সব গুলো চিন্তা করলে আমাদের মেনে নিতে হবে যে, ইতিকাফ মসজিদে হওয়া উচিৎ। তাই ঘরে ইতিকাফ করতে চাইলে সুন্নাত ও শারঈ যে ইতিকাফ কুরআন ও হাদীস দ্বারা সাবিত হয়, তা পূর্ণতা পায়না।
২- এ বছর করোনার বছর, অনেক বিষয় এখানে আমাদের “দরুরাতে” (অত্যাবশক প্রয়োজনের অধীনে শরীয়াতের মাসআলা নির্ধারণের নীতিমালা) নিয়ে আসতে হয়েছে। যাদের প্রতি বছর ইতিকাফ করার অভ্যাস আছে, এবং এ বছর ও তাদের হাতে আছে সময়, ও সুযোগ। এদের ঘরের ভেতর এমন যায়গাও আছে, যেটা সালাতের জন্য নির্দিষ্ট। সেখানে কোন রকম সমস্যা তো নেই ই, বরং ইতিকাফ ভঙ্গের কোন ক্ষেত্র তৈরিও হবেনা। এই সব ফেসিলিটি নিয়ে একজন ভাই যদি ইতিকাফ করতে চান। যাতে তার নিয়্যত হলো, তিনি প্রচুর ইবাদাত করবেন, কুরআনের সাথে সময় কাটাবেন, যিকির আযকারে একাকিত্বে থাকবেন, এবং কিছু গবেষণা ধর্মী কাজও করবেন। এই ক্ষেত্রে ভাই কি ইতিকাফের নিয়্যত করে ঘরে বসবেন? আমি ভেবে দেখেছি, তার ক্ষেত্রে ইতিকাফের আলাদা নিয়্যতের দরকার কি? তার এই “মাসজিদুল বায়তে” যদি তিনি নিজকে আটকে ফেলেন, এবং রমাদানের শেষের দশ দিন ইতিকাফের মত করে কাটিয়ে দেন তা হলে তো হয়ে যায়। ইতিকাফের সাওয়াবটা হয়ত তিনি পেয়েও যেতে পারেন। নিশ্চিত ভাবে এটা বলা যায়, এই ভাই লায়লাতু ক্বাদর খোঁজার ক্ষেত্রে ইতিকাফের যে উপকারিতা, একাকিত্বে ইবাদাতে মজা নেয়ার যে উদগ্র আকাংক্ষা, নির্জনে স্ট্যাডির যে সুযোগ সবই এই ভাবে পেতে পারে। কিন্তু তাকে সুন্নাতি ইতিকাফ মনে করার দরকার নেই।
৩- কিছু কিছু ফুক্বাহা ভাবছেন নিজ গৃহের “মাসজিদুল বায়তে” ইতিকাফ করা যাবে। তারা বলছেন ইমাম কুরতুবি যে ইজমা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ শুদ্ধ নয়। কারণ মালেকি মাযহাবের মুহাম্মাদ বিন উমার বিন লুবাবাহ আলমালিকি বলেছেন, ইতিকাফ মসজিদে হোক বা বাড়িতে দুনিয়ার যে কোন স্থানে করা যাবে। ইমাম আবু হানীফা (র) ও তার অনুসারীদের মতে মেয়েদের ইতিকাফ “মাসজিদুল বায়ত” বা ঘরের ভেতরে সালাতের জন্য পৃথককৃত স্থানে করা যায়। ইমাম শাফেঈর (র) ও পুরোণো একটা মত এমনি আছে। ইমাম ইবন হাজার আসক্বালানী (র) বলেন, মালেকিগণের দৃষ্টিতে নারী পুরুষ উভয়ের জন্যেই ঘরে ইতিকাফ করা জায়েয। (ফাতহুল বারী, ৪/২৭২) কারণ সকল মুসলিমদের ইজমা’ হলো ঘরে ই নফল ইবাদাত আদায়ের সেরা যায়গা। অতএব ইতিকাফের মত নফল বা সুন্নাত ইবাদাত ঘরে করা অবশ্যই যাবে। কেও কেও নিম্নোক্ত হাদীসটা উল্লেখ করেছেন।
«لا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقابِرَ.
অর্থাৎ তোমাদের ঘরকে তোমরা কবরখানা বানায়ো না। (মুসলিম)
এরই উপর ভিত্তি করে তারা বলেন, ঘরে যদি সুন্নাত ও নফল সালাত আদায় করা বেশি সওয়াবের হয়, তাহলে ইতিকাফও ঘরে বৈধ হবে। আমার কাছে এই গবেষণাটা ঘুব বেশি জোরালো মনে হয়নি। কারণ ইবাদাতের ধরণ কিয়াসের মাধ্যমে সাবিত করার চেয়ে মহানবীর (সা) আমল দিয়েই সাবিত করা বেশি ভালো। কারণ ইবাদাতকে “তাওকীফি” তথা অহির উপর নির্ভরশীল করে রাখায় কল্যান বেশি।
এইজন্য আমি বলি, “শরঈ হাইসিয়্যাত” এ ঘরের মাসজিদকে মাসজিদ নির্ধারণ করে বাসায় ইতিকাফের ইসলামি রঙ দেয়ার দরকার নেই। বরং কারো মন চাইলে ঘরে ইতিকাফের মত নিজকে আবদ্ধ রেখে ইবাদাত করতে পারবে। যেহেতু তার মন প্রতিবারের ইবাদাতের প্রতি উদগ্রীব কিন্তু মাসজিদে যেতে পারছেনা বলে যাচ্ছেনা। আর আল্লাহ কোন ব্যক্তির সামর্থের বাইরে কষ্ট দেননা। (আলবাক্বারাহ ২৮৬)। আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহকে ভয় করো। (আত তাগাবুন, ১৬)। আমাদের নবী (সা) বলেছেন, আমি যা নিষেধ করেছি তা তোমরা ছেড়ে দাও। আর যা করতে নির্দেশ দিয়েছি তা “যথা সম্ভব” করো। (মুসলিম, ১৩৩৭)। তাছাড়া কাওয়ায়েদ ফিক্বহিয়্যাহ এর মৌলিক নীতি মালার একটা হলোঃ المشقة تجلب التيسير মানে কাঠিন্যের জন্য সহজতা আসে। অন্য আরেকটা মূলনীতি হলো, الأمر إذا ضاق اتسع কোন বিষয় মানতে যত সংকীর্ণ হয়, তার সমাধানে ইসলাম ততো উদার হয়। এইসব গুলো বিবেচনায় বাসায় কেও ঘরে ইতিকাফ করতে চাইলে আমি নিষেধ করবো না। তবে ৩টা বিষয় মাথায় রাখা উচিৎঃ
১- এইটাই মসজিদের ইতিকাফের মত মনে না করে ইতিকাফের আবহে ইবাদাত করে যাওয়া মনে করুন। আল্লাহ আপনার ইখলাস, কান্না ও আবেদন নিবেদন দেখে মসজিদে ইতিকাফের চেয়েও বেশি সাওয়াব দিতে পারেন।
২- এখন করোনার কারণে পরিবারের সবাই কার্যতঃ বন্দী। এই সময় বাচ্চাদের রিক্রিয়েশানের সুযোগ একদম নেই। তাদের জন্য ঘরের ভেতর এই ধরণের ইতিকাফি জীন্দেগী আরেকটা কাঠিন্য নিয়ে না আসুক। আমার তো মনে হয় এই সুন্নত আমলের চেয়ে বাচ্চা ও বিবিকে নিয়ে ইসলামিক বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করা, কুরআন পড়া ও পড়ানো বা মুখস্ত করা, হাদীস পড়া, সীরাত অধ্যায়ন করা, ফিক্বহ নিয়ে আলোচনা করা একাকি ইতিকাফের চেয়ে অনেক অনেক সাওয়াবের কাজ। একদিন আপনার সন্তানেরা এই গুলোই মনে রেখে আপনার জন্য দুয়া করবে।
৩- করোনা ভাইরাসের জন্য অনেক ফরজ ওয়াজিব কাজ গুলোও আমরা করতে পারছিনা ঠিক মত। সেখানে ইতিকাফ না করতে পারলে আমাদের কোন গুনাহ হবেনা ইনশাআল্লাহ। কাজেই কেও এইটা করতে পারছেন না বলে আফসোস না করে ইবাদাতে মন ব্যস্ত রাখি। তাতেই আমাদের সাওয়াব বেশি দেবেন আল্লাহ।
আমরা দুয়া করি করোনার মহামারি আল্লাহ উঠিয়ে নিন। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের কাজ কাম স্বাভাবিক হয়ে আসতেছে। হয়ত আল্লাহ তাড়াতাড়ি আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচাবেন। আল্লাহ কবুল করুন।