দরকার কাজেরঃ
ইসলামি আন্দোলনের উচিৎ হলো, অযথা তর্ক বিতর্কে না জড়িয়ে, চিন্তা ও সময়গুলোকে কাজের মধ্যেই নিয়োগ করা। প্রত্যেক মুসলিমের কাছে আজকে বিশেষ করে এই বিপদের দিনে ইসলাম এই জিনিষটাই চাচ্ছে। এখনই হলো কাজের আসল সময়। উম্মাতের উপর এমন বিপদের সময় এখন, অনেক জ্ঞানী সহনশীল মানুষ ও সংশয়গ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। মহানবী (সা) বলেছেনঃ “তোমাদের সামনে আসছে সবরের সময়। এ সময় সবর করার মানে হবে যেন খালি হাতে জ্বলন্ত অংগার রাখা। সে সময় যারা ইসলামের জন্য কাজ করবে তাদের একজনকে পঞ্চাশ জনের আমলের সমান প্রতিদান দেয়া হবে”। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, প্রতিদানটা আমাদের পঞ্চাশজনের সমান নাকি তাদের পঞ্চাশ জনের সমান? মহানবী (সা) বললেনঃ “বরং তোমাদের পঞ্চাশ জনের সমান”।
আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ “এবং বলুনঃ তোমরা আমল কর, কাজ কর, তোমাদের কাজ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ অচিরেই দেখবেন। এরপর তোমাদের ফিরে যেতে হবে অদৃশ্য ও দৃশ্য সমূহের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে। তখন তোমরা যা করেছো তার সংবাদ তিনি তোমাদের দেবেন। (আততাওবাহঃ ১০৫)
ইমান ও আমলের মর্যাদা নিয়ে উলামাগনের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। আমল কি ইমানের অংশ, নাকি ইমানের জন্য শর্ত, না ইমানের পরিপূর্ণতা বিধান কারি? হাজারো মতানৈক্যের মধ্যে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে আমল ছাড়া সত্যিকারের ইমান বাস্তবে রূপায়িত হতে পারেনা।
আলকুরআন আলকারীম ইমান কে বিভিন্ন আমলের প্রতিকৃতিতে তুলে ধরেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ “ইমানদাররা অবশ্যই সফলতা লাভ করেছে। যারা সালাতের মাঝে খুবই বিনয়ী। যারা বৃথা কথা বা আচরণ থেকে মুখ ফিরায়। যারা যাকাতের অনুষংগে কাজ করে। যারা নিজেদের গুপ্তাংগ হিফাজাত করে। তবে স্ত্রী ও দাসীদের সাথে যৌনাচারে তাদের কে ভর্ৎসনা করা হবেনা। কেউ এদের বাইরে অন্য কাওকে কামনা করলে তারা সীমালংঘন কারী হিসেবে পরিগণিত হবে। যারা আমানাত ও অংগীকার যথাযথ ভাবে পালন করে। যারা তাদের সালাত সমূহ পরিপূর্ণ ভাবে হিফাজাত করে”। (মু’মিনূনঃ ১-৯) তিনি আরো বলেছেনঃ “ইমানদারদের গুণ হলো, তাদের সামনে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, মন তাদের কেঁপে ওঠে। তাদের সামনে যখন আল্লাহর আয়াৎ সমূহ তিলাওয়াত করা হয়; ঈমান তাদের বেড়ে যায়; এবং প্রতিপালকের উপর তারা নির্ভর করতে থাকে। তারা সালাত ক্বায়িম করে, আর আমার দেয়া রিযিক থেকে তারা ব্যয় করে। তারাই হলো আসল ইমানদার”। (আল আনফালঃ২-৪) তিনি বলেছেনঃ “ইমানদারদের গুণ হলোঃ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ইমান আনে এবং তাতে কোন সংশয় রাখেনা। আর অর্থ সম্পদ ও জান দিয়ে তারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে, তারাই হলো সত্যবাদী”। (আলহুজুরাতঃ১৫) এমনি ভাবে শত শত আয়াতে আল্লাহ আমল কে ইমানের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। যেমন দেখুনঃ “নিশ্চয় যারা ইমান এনেছে আর ভাল কাজ করেছে, আমি তাদের করা ভালো কাজ কখনো ধ্বংশ করবোনা”। (আলকাহাফঃ৩০) “সময়ের শপথ, মানুষ নিশ্চিতই ক্ষতির মাঝেই আছে। তবে যারা ইমান এনেছে, ভাল কাজ করেছে, একে অপরকে সঠিক কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে, এবং একে অপরকে সবর করার পরামর্শ দিয়েছে তারাই কেবল ব্যতিক্রম”। (আলআসরঃ ১-৩) কুরআনে অন্য স্থানে ভাল কাজ করা কে জান্নাতে যাওয়ার উপায় হিসাবে দেখানো হয়েছেঃ “তোমরা কাজ করতে, এইজন্য তোমাদেরকে ঐ জান্নাতের ওয়ারিস বানিয়েছি”। (আলযুখরুফঃ ৭২) “তোমরা যে কাজ করতে তার বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ কর”। (আল নাহালঃ ৩২)
হাদীসে ভালো কাজ সমূহকে ইমানের শাখা প্রশাখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বুখারি ও মুসলিমের একটা হাদিসে বলা হয়েছেঃ “ইমানের ষাট কিংবা সত্তরটার বেশী শাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হলো ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এর ঘোষণা দেয়া। আর সর্বনিম্ন হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিষ সরিয়ে ফেলা। লজ্জাশীলতা হলো ইমানের অন্যতম একটা শাখা”। এর উপর ভিত্তি করে ইমাম বায়হাকি অনেক বড় একটা বই লিখেছেন ‘আলজামে’ই লিশু’য়াবিল ইমান’ নামে। এখানে তিনি কুরআন হাদীসের আলোকে ইমানের শাখা প্রশাখা গুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন।
কার কাজ সবচেয়ে ভালোঃ
এখানে একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। আল্লাহ তাআলা কিন্তু কুরআনের মধ্যে আমাদের মধ্য থেকে কে সবচেয়ে ভালো কাজ করবে তার পরীক্ষা নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনবার তিনি এই কথাটাকে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “ তিনি আসমান যামিন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। আর তাঁর আসন ছিলো পানির উপর। এতে করে তোমাদের পরীক্ষা নেবেন কে বেশী ভালো কাজ কর”। (হুদঃ ৭) তিনি আরো বলেছেনঃ “আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে”। (আলকাহাফঃ ৭) অন্যত্র তিনি বলেছেনঃ “যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়”। (আল মুলকঃ ২)এই আয়াত গুলোর অর্থ হলোঃ আসমান যামিনের সব কিছু, হোক সে উপরের অদৃশ্যালোকে কিংবা হোক সে গভীর নিচের গহবরে, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর উপরে যা কিছু বানায়েছেন, তা পৃথিবীর সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজেই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন খুব গুরুত্বপূর্ণ এক কারণে। সেই কারণ টা বর্নিত হয়েছে তাঁর বক্তব্যের মাঝে। আর তা হলো ‘তোমাদের তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে কে কাজে শ্রেষ্ঠ’ তা নিরুপন করতে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ কিন্তু শ্রেষ্ঠ কাজ কার হয়, সেটাই পরীক্ষা নিতে চান। তিনি বলেন নি ‘আমি পরীক্ষা করতে চাই কে ভালো কাজ করবে বা কে মন্দ কাজ করবে’। এখানে আমাদের জীবন দেয়া বা কেড়ে নেয়ার পেছেনে পরীক্ষা কখনোই আমাদের ভালো মন্দ কাজের খতিয়ান নেয়া নয়, তিনি দেখতে চেয়েছেন কে আমরা কাজে ভালো, আর কে শ্রেষ্ঠ। তিনি শুধু ভালো কাজেই পূর্ণ খুশি নন। তিনি শ্রেষ্ঠ কাজ দেখতে চান। ইসলামি আন্দোলন কর্মি শুধু ভালো কাজ করবে না, বরং শ্রেষ্ঠ কাজ করবে। কুরআনের আয়াত গুলো কিন্তু আমাদের কে শ্রেষ্ঠ কাজের প্রতিযোগিতার দিকেই আহবান করছে।
এই জন্য ইসলাম শুধু কাজ করার জন্য আমাদের বলেনা। বরং আমাদের খুব সুন্দর গোছানো কাজের দিকে আহবান করে। কাজে পরিপাটি অর্জন করা তাই ইসলাম বাধ্যতা মূলক করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ “কাজ তোমরা সুন্দর ভাবে করো। আল্লাহ সুন্দর ভাবে কাজ সম্পাদন কারিকে পছন্দ করেন”। (আলবাকারাহঃ ১৯৫) মহানবী (সা) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য যে কোন কাজ সুন্দর করে সম্পাদন করা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন। হত্যা করতে হলেও সুন্দর ভাবে তা করবে। কোন প্রাণী যবেহ করতে গেলেও তা করবে সুন্দর ভাবে”। এখানে ‘কাতাবা’ বা ‘বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন’ শব্দটা কোন কাজ বা বিষয় একেবারে ফারদ করা হলে বলা হয়। সিয়াম সাধনা ফারদ করার ক্ষেত্রেও এই শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। এই জন্য আমরা সাহাবীগণের যুগে দেখতে পাই কোন কাজে কে সবচেয়ে ভাল করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলতো।
ইপ্সিত কাজঃ
মনে রাখতে হবে, কাজ করতে হবে এটা খুব জরুরী না, জরুরি হলো আমাদের ভালো কাজ করা। এর চেয়েও বেশি জরুরি হলো কাজ আমাদের খুব সুন্দর করে করা এবং শ্রেষ্ঠ কাজের দিকে আমাদের প্রানান্ত চেষ্টা থাকা। “আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা নেবেন কে তোমাদের কর্মে শ্রেষ্ঠ হবে”। (আলমুলকঃ ২), “আপনি আমাদের বান্দাহ দের বলুন তারা যেন শ্রেষ্ঠ কথা বলে”। (আলইসরাঃ ৫৩), “জওয়াবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট”। (ফুসসিলাতঃ ৩৪), “তাদের সাথে বিতর্ক করুন শ্রেষ্ঠ পন্থায়”। (আলনাহলঃ১২৫), “এতীমদের ধনসম্পদের কাছেও যেয়ো না; কিন্তু সর্বোত্তম পন্থায় হলে যেতে পার”। (আলআনআমঃ ১৫২)এই সব আয়াতে ইসলামি আন্দোলন কর্মিদের কর্মপন্থা বলে দেয়া হলো। আমাদের শুধু মাত্র সুন্দর কাজ করতে বলা হচ্ছেনা, বলা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম কাজ করতে।
শ্রেষ্ঠ কাজ করার পদ্ধতি কি? একটা পদ্ধতি হলো সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে সঠিক কাজটাই করা। এই ধরণের কাজ আমরা আগেও করবনা দেরী করেও না। আর এই ভাবে কাজ করতে শিক্ষা দেয়ার জন্য সালাত ও সিয়ামকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে সময়ের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। “নিশ্চয় সালাত কে মু’মিনদের উপর সময়ের সাথে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে”। (আলনিসাঃ ১০৩), “আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত”। (আলবাকারাহঃ ১৮৭)
শ্রেষ্ঠতম ভাবে কাজ করার আরেক পদ্ধতি হলোঃ যে সব কাজ আগে করা উচিৎ তা আগে করবো। যে সব কাজ পরে করা দরকার তা পরেই করব। শরীয়াত যে কাজের মর্যাদা যেখানে রেখেছেন, সেখানেই তার মর্যাদা রাখব। ফারদের উপর কোন নফল কাজকে আমাদের প্রাধান্য দেয়া উচিৎ নয়। কোন শাখা কে তার মূলের উপর মর্যাদা দেয়া আমাদের ঠিক নয়। কোন মুস্তাহাব কাজ করতে যেয়ে হারাম পথ আমরা গ্রহন করব না। অথবা কোন মাকরুহ বিষয় পরিহার করতে আমরা কোন কাজকে ফারদ করে দেবোনা। ফারদ কিফায়াহ কে উচিৎ নয় ফারদ ‘আইন এর উপর প্রাধান্য দেয়া। আমি এই সব বিষয় জানার নাম দিয়েছি ‘ফিক্বহ আল আওলাওয়িয়্যাত’ বা প্রাধান্য দেয়ার জ্ঞান।
আমাদের কাজকে শ্রেষ্ঠ করার আরেক পদ্ধতি হলোঃ আমাদের প্রতিটি কাজকে অত্যন্ত টার্গেট ভিত্তিক হওয়া দরকার এবং তা করার উদ্দেশ্য যেন থাকে খুবই পরিস্কার। মুসলমানদের কোন কাজ উদ্দেশ্য বিহীন হওয়া উচিৎ না। সেই টার্গেট ও উদ্দেশ্যে পৌঁছতে আমাদের উচিৎ সঠিক পদ্ধতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করা। এটা করতে হবে আমাদের সংগতি ও পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে। আমাদের ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে এবং এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে খুবই সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এভাবেই হয়ত আমাদের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে। আল্লাহ মানুষের কোন আমল নষ্ট করে দেননা।
দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য আমাদের আমল হতে হবেঃ
এখানে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার, তা হলো আমাদের কিন্তু ভুলে গেলে চলবেনা যে, আমরা দুনিয়ার জন্য যে আমল করি তা কিন্তু আমাদের দ্বীনের আমলের অংশ। দুনিয়া যদি আমাদের শেষ করে ফেলি, দ্বীনের কিছুই থাকবেনা আমাদের। ইসলামের বৈশিষ্ঠ্য হলো দুনিয়া আর আখিরাতের মধ্যে এখানে কোন পার্থক্য করা হয় না; এতদুভয়ের মাঝে কোন শত্রুতাও ইসলাম মেনে নেয় না। আর এই জন্যই দেখি মহানবী (সা) কুরআনের শিখিয়ে দেয়া একটা দুয়া বার বার পড়তেনঃ “আল্লাহ তুমি আমাকে দুনিয়ার কল্যান দান কর, দান কর আখিরাতের কল্যানও, আর জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদের বাঁচাও”। (আলবাকারাহঃ ২০১) কুরআনে বলা হচ্ছে মু’মিনদের দুনিয়ার যতটুকু দেয়া হবে, দুনিয়ার যে কল্যান ও সৌন্দর্য তাদের ভাগ্যে নির্ধারণ হবে, তা আখিরাতে দেয়া তাদের প্রতিদানের অংশ বিশেষ। এর পরে আখিরাতে দেয়া হবে পরিপূর্ণ হিসসা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আল্লাহ তাদের কে দুনিয়ার প্রতিদান দিলেন, এবং আখিরাতের সুন্দর প্রতিদানও”। (আলইমরানঃ ১৪৮), তিনি বলেছেনঃ “ইমান থাকা অবস্থায় যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, সে পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে ‘হায়াতুন তাইয়েবা’ বা পবিত্র জীবন দান করব”। (আলনাহলঃ ৯৭) তিনি আরো বলেনঃ “তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন”। (নূহঃ ১০-১২)
কাজেই আমল শুধু মাত্র দ্বীনি কাজের সাথে যুক্ত নয়, দুনিয়ার সাথেও তা জড়িত। যে দুনিয়াতে সুন্দর জীবন চালাতে চায়, এবং ভালো ভাবে দিন যাপন করতে চায়, তাহলে তাকে কাজ করতে হবে। কাজ ছাড়া দুনিয়ার ভালো জীবন আশা করা যায় কি করে? আর এই জন্যই তো তাঁর নির্দেশঃ “তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব, তোমরা তার কাঁধে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া রিযিক আহার কর”। (আলমুলকঃ ১৫) কাজেই যে আল্লাহর এই আহবানে সাড়া দিয়ে আল্লাহ কর্তৃক সুগম করা এই দুনিয়ার উপর বিচরণ করে বেড়াবে, এই পৃথিবীর আনাচে কানাচে নিজের ইনকামে ও রিযিকের অণ্বেষণে বের হবে, সে অবশ্যই আল্লাহর দেয়া রিযিক সেখানে লাভ করবে। তবে কেও যদি অলসতা করে, ঝিমিয়ে থাকে, ঘরের কোণে পড়ে থাকে বা দুনিয়ার কাঁধে না বিচরণ করে তা হলে আল্লাহর রিযিক সে পাবে কোত্থেকে?
আল্লাহ এই জগৎকে কিছু নিয়মের মধ্যে তৈরী করেছেন। তার বাইরে গেলে চলবেনা। এখানে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত জালের মধ্যে এই জগতের সব গুলোকে বেঁধেছেন। এখানে রয়েছে নানা কার্যকরণের সমষ্ঠি। প্রতিটি কার্যকরণের সাথে আছে অনেক শর্তসমূহ ও নীতিমালা। এগুলো মেনে না চললে আপনি এখানে বসবাস করবেন কিসের ভিত্তিতে?
এই জন্য আমরা দেখতে পেয়েছি সাহাবী ও তাবেয়ীগণ যখন বিজয় অর্জনের কার্যকরণ গুলো আয়ত্বে আনতে পেরেছিলেন, এবং বিজয়ের জন্য দ্বীনি ও পার্থিব, বস্তুগত কিংবা আধ্যাত্মিক শর্তগুলো পূর্ণ করতে পেরেছিলেন, অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য গুলোর উপর বিজয়ী হতে পেরেছিলেন তারা। এভাবে যখন ইসলামি সভ্যতা বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত উন্নতিতে এবং সৃষ্টিশীল প্রতিভার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কর্ম কান্ডে, সবার উপরে উঠার যোগ্যতা অর্জন করলো, দুনিয়া তার কাছথেকে অনেক কিছু শিখতে পারলো। এটা এমন এক সার্থক সভ্যতার জন্ম দিলো যাতে ইমান ও বিজ্ঞানের সাথে ছিল অভূতপূর্ব যোগসুত্র। মিলন হলো বস্তুর সাথে আধ্যাত্মিকতার। পৃথিবী মিললো আকাশের সাথে, আর দুনিয়া মিললো আখিরাতের সাথে।
শুধু রাজনৈতিক কর্মকান্ডই যথেষ্ঠ নাঃ
কিছু কিছু ইসলামি আন্দোলন এখন রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত। তার সমস্ত সংগ্রাম সাধনা রাজনীতিতেই লোক সমাগম করা। তাদের চিন্তা, অনুভুতি, সাংগঠনিক কার্যক্রম সবই অনইসলামিক সরকারদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত। অথচ এরা অনেক ধরণের ভালো, উপকারী, জরুরি এবং সম্ভাবনাময় কাজ থেকে বেশ দূরে থাকে। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে সময় দেয় না। ওরা শিক্ষা প্রশিক্ষনে সময় বেশি লাগায় না। সামাজিক কর্মকান্ডে এদের সময় একদম নেই। অথচ এই কাজ গুলো কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে আলাদা না, বরং রাজনীতির সফলতার জন্য এগুলোকে অবশ্য করণীয় কাজ হিসাবে মানুষ গ্রহন করে নিয়েছে।
রাজনীতিতে আমাদের জনসমর্থনের বিশাল ঘাঁটি প্রস্তুত করা দরকার। ইসলামি রাজনীতির সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা গুলোকে একে অন্যের কাছাকাছি আনতে হবে। আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার দাবীকে গণ দাবীতে পরিণত করতে হবে। আমাদের দরকার সাম্রাজ্যবাদিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে পিষ্ট ও প্রভাবিত বুদ্ধিজীবি পরিমন্ডলকে মুক্ত করে নিয়ে আসা। তা করতে আমাদের দরকার হবে অত্যন্ত আধুনিক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা উপস্থাপন, যা তাদের স্ট্যান্ডার্ড মত করে উপস্থাপিত হবে। তারা যে সব বিষয় কে মূল মনে করে নিয়ে গবেষণারত, তার বিপক্ষে ইসলাম কে যুক্তি যুক্ত বক্তব্য ও বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। সাধারণ মানুষদের ইসলাম বুঝাতে যে ওয়াজ ব্যবহার করা হয়, তা এখানে খাটবেনা। আল্লাহ বলেছেনঃ “আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে”। (ইব্রাহিমঃ ৪)
কাজেই প্রতিটি ইসলামি আন্দোলনের উচিৎ আমাদের এই বুদ্ধিজীবি শ্রেনীকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে পারার যোগ্য লোক তৈরী করা। যাদের উপস্থাপনা ও ভাষা কখনোই সাধারণদের মত হবে না। সাধারণদের এক ভাষা, বুদ্ধিজীবিদের ভাষা আলাদা। আন্দোলনের উচিৎ এই সব শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছবার যোগ্যতা অর্জন করা। রাজনৈতিক কর্ম কান্ডে সফলতা লাভ করতে হলে আমাদের উচিৎ এমন এক জেনারেশান তৈরী করা যারা, দ্বীন কে বুঝবে পরিপূর্ণভাবে। যারা দুনিয়ার জ্ঞানে কখনো পিছিয়ে থাকবেনা। যাদের আক্বীদা বিশ্বাস হবে একদম নির্ভেজাল। যারা ইবাদাত করবে সহিহ সঠিক পন্থায়। চরিত্রে যারা মধুর হবে এবং অবদান রাখা হবে কিংবা সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারি হবে। তারা নিজেরা যেমন সৎ হবে, অন্যকেও সংশোধন করার মত শক্তি ও প্রভাব রাখবে।
আজ ইসলামি আন্দোলন গুলোর দ্বায়িত্বশীলদের বা আলিম উলামাদের বিভিন্ন শক্তি সরকার যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ক্ষয় করতে হচ্ছে। কিংবা এমন যুদ্ধে তাদের জড়িয়ে পড়তে হয় যেখান থেকে কোন উপকার না ইসলামের হয়, না দেশের। এই অযথা ও অনাকাংখিত যুদ্ধ যুগের পর যুগ চলতে থাকার কারণে একদিকে যেমন শক্তির অপচয় হয়, অপর দিকে উম্মাহ এক ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে যায়। যা দেখে শত্রুরা অত্যন্ত আনন্দ পায়, তাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। এবং দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রে তারা সফল হিসেবে হয় বিবেচিত।
ইসলামি আন্দোলন গুলোর এখন উচিৎ তাদের কার্যক্রম সামনে নিতে এমন সব পথ খুঁজে বের করা, যাতে তাদের আসল উদ্দেশ্য ব্যহত না হয়। তাদের উচিৎ সরকারযন্ত্রে থাকা বিচক্ষন ব্যক্তিদের সাথে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করা। এতে করে দেশ ও জাতির অভিন্ন কল্যানে সবাই এক হতে চেষ্টা করতে হবে, এমন কি অনেক ছাড় দিয়ে শুধু দুনিয়ার কল্যানে একমত হয়েও।