সেদিন ভাইরাল হওয়া এক ভিডিও দেখলাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এক পীর সাহেব চিৎকার করে বলছেন, ওরা বলে “ইল্লাল্লাহ” বলে নাকি যিকির করা যাবেনা। অথচ কুরআনে “ইল্লাল্লাহ” যিকির আছে।
এই পীর সাহেব হুজুর এর খলীফা তুল্য এক কিংবদন্তী “ওয়াইয”ও এই কথাটা গত বছর চিৎকার করে বলেছিলেন, এটা নাকি কুরআনে আছে।
আসলে কুরআনে তো কত কিছু আছে। একবার আমার দুয়া নিতে আসা এক মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি, মা? বললো, “তুকাযযিবান”। আমি বিস্ময় বোধ করলে মেয়েটির মা হেসে বললো, “হুজুর এই মেয়ে পেটে আসলে সূরা রহমান পড়তাম রাত দিন। দেখলাম আল্লাহ “তুকাযযিবান” বার বার কইছেন। ভাবলাম এইটা দেই”। আমি বললাম, আপু, এইটা তো বাক্যের শেষের কথা। ওর আগের গুলো না বলে শুধু তুকাযযিবানের অর্থ হবে, (হে জিন ও মানব) তোমরা (দুইজন) মিথ্যারোপ করবে। এই অর্থহীন নামের আসল অর্থ শুনে মেয়েটা লজ্জায় একদম এতটুকুন হয়ে গেল। বললো, মাম, ইট ডাযন্ট মেইক সেন্স, মা এর কোন অর্থ হয়না। কিন্তু মা কি কম?! তিনি ক্ষেপে গেলেন। আমাকে শুনিয়ে দিলেন, তাদের বাসায় আসা মিঞা সাহেব বলেছেন, নামটা বেশ ইউনিক ও সুন্দর। আমি আর কি বলবো, মিঞা সাহবের কল্পিত মুখ মাথায় নিয়ে আপন মুখটা ব্যাদান করে বসে গেলাম। ঐ সব মিঞা সাবদের মত জ্ঞান আমাদের আছে নাকি?!
যাহোক আমাদের পীর সাহেব হুজুর ও আরেকজন শায়খ এই ইল্লাল্লাহর যিকির কুরআনে আছে বলে একটা আয়াতের দলীল দিয়েছেন। ঐটা সূরা আলইমরানের ১৩৫ নাম্বার আয়াত।
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّـهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّـهُ
এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন মুহসিনিন বা জান্নাতের অধিবাসী হবার যোগ্যতা রাখবে তারাই, “যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে, অথবা নিজদের উপর অত্যাচার করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে, ফলে তাঁর কাছে মাফ চায়। আর কে আছে এমন যে মাফ করবে ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কে মাফ করবে?
এখানেই বুঝা যায় এই শব্দদ্বয় দিয়ে যিকির করা যাবে কিনা। কারণ এই শব্দের অর্থ হলো “আল্লাহ ছাড়া”।
আসলে যিকির মানে কি? যিকির মানে আল্লাহকে স্মরণ করা। কিভাবে তাঁকে স্মরণ করবো? যিকির করবো যে ভাবে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন ও তাঁর রাসূল (সা) আমাদের শিখিয়ে গেছেন। সুরা আলবাক্বারার ২৩৯ আয়াতটা পড়লে তাই বুঝা যায়। তিনি বলেছেন, অতঃপর আল্লাহকে স্মরণ করো, যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন।
আপনি শুধু আল্লাহ বলে যিকির করেন ঠিক আছে। সূরা ইসরা এর ১১০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ আমাদের এটা শিখিয়েছেন। তিনি বলছেনঃ
قُلِ ادْعُوا اللَّـهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَـٰنَ ۖ أَيًّا مَّا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ ۚ
অর্থাৎ তোমরা আল্লাহকে ডাকো বা রাহমানকে ডাকো, যে নামেই ডাকো তাঁর আছে সুন্দর সুন্দর নাম। এখানে আল্লাহকে আল্লাহ বলে ডাকায় কোন সমস্যা নেই এইটা বুঝানো হয়েছে। যখন আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, প্রিয় সত্ত্বাকে ডাকতে মন চাচ্ছে, “আল্লাহ” বলে ডাক দেন। তাঁর নামে এতো মধু বারবার ডাকতে মন চাচ্ছে, বারবার আল্লাহ আল্লাহ করেন।
আপনি জান্নাতে যেতে চান যিকির করে? আল্লাহ শিখাচ্ছেন যে, প্রতিটি ফরদ্ব সালাত শেষান্তে যদি আয়াতুল কুরসি পড়েন তাহলে ঐ যিকিরেও জান্নাত পাবেন। যা শুরু হয়েছে,
اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ
মানে “আল্লাহ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই”। শুরু করুন আল্লাহ দিয়ে। এর পরে বলুন কোন ইলাহ নেই ইল্লা হুয়া “তিনি ছাড়া”। আগে কিছু না বলে “ তিনি ছাড়া” বললে অর্থদায়ক বাক্য হয়না।
আমাদের নবী (সা) তাই সুন্দরভাবে বলেছেনঃ
أَفْضَلُ الذِّكْرِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ، وَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ الحَمْدُ لِلَّهِ
মানে সেরা যিকির হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আর সেরা দুয়া হলো আলহামদু লিল্লাহ।
এই হাদীসটা এতো বিখ্যাত এবং সহীহ যে, তা নিয়ে ভাব্বার দরকার নেই। নিঃসন্দেহে পড়ুন “লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ”। এইটা এতো প্রিয় যে আমাদের নবী (সা) এটাকে অযুর পরে পড়তে বলেছেন, ঘুম থেকে উঠে, দিনের প্রারাম্ভে, সালাত শেষ করার পরে, বিপদের আপদে, আরাফার ময়দানে সব খানে, সব স্থানে তিনি এটা পড়তেন। এই যিকির হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। নেই কোন ইলাহ আল্লাহ ছাড়া।
এখন কেও যদি “লা ইলাহা” মানে “নেই কোন ইলাহ” শব্দ দ্বয় বাদ দিয়ে শুধু “ইল্লাল্লাহ” বলে তাহলে কি দাঁড়ায়। এই বিশাল বরকতময় আরবি বাক্যকে যদি একটি বাঁশ মনে করেন, তাহলে শুধু “ইল্লাল্লাহ” বললে বাঁশের গোড়া বাদ দিয়ে আগায় ঝোলার মত হয়ে যাবে। আরবি ভাষা হবে না। এই সহজ জিনিষটা বুঝতে আপনাকে আলিম হতে হবেনা। বা এমনকি শিক্ষিত হবার ও দরকার নেই আপনার। শুধু যদি এর অর্থ টা বুঝে নেন, তা হলে আপনি নিজেই পীর সাহেবের সামনে বলতে পারবেন, না তো হুজুর, এটা দিয়ে যিকির হয় কি করে?
যিকির হতে গেলে একটা অর্থ থাকে। আল্লাহ বলে ডাকলে একটা অর্থ হয়। আমার আব্বা জীবিত থাকতে আমি একদিন ডাকলাম, আব্বা, আব্বা, আব্বা আপনি কেমন আছেন? এর অর্থটা এমন পরিস্কার ছিলো যে আমার মেঝ বোনের সাথে অসুস্থ আব্বা বলছেন, আজকে একটা ছেলে আমাকে খুব আদর করে আব্বা আব্বা করে ডেকেছে। সে কে তুমি জানো? আমার বোন বললো, ওতো আমাদের বড় ভাই। আপনার ছেলে, আব্দুস সালাম। আব্বা নাকি চোখের পানি ফেলেছিলেন, বললেন, ঐ ছেলে কি আবার ফোন করবে? ঐ রকম মিষ্টি করে কি ডাকবে?
আল্লাহ নামে ডাকলে আল্লাহর উলুহিয়্যাতের সাগরে ঢেও ওঠে। বান্দার ডাকের জবাব দেন। তাকে কবুল করেন।
আমি যদি আমার আব্বা কে বলতাম, “আব্বা ছাড়া”, “আব্বা ছাড়া”। তা হলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আব্বা আমাকে লা’নত করতেন। বলতেন, বেটা আব্বা ছাড়া, আব্বা ছাড়া, মানে আমি ছাড়া আর কোন পামরকে তুই আমার যায়গায় বসাচ্ছিস। ঠিক অমনই হবে, কেও “আল্লাহ ছাড়া” “আল্লাহ ছাড়া” বলে যিকির করলে। আল্লাহকে রাগানোর জন্য এই “ইল্লাল্লাহ” বা “আল্লাহ ছাড়া” বলাই যথেষ্ঠ।
আমার দুলা ভায়ের আব্বা ছিলেন আমার দেখা ভালো মানুষদের একজন। শেষ বয়সের দিকে তার কেমন যেন “ভাবে” পেয়ে বসে। আমার বড় বোন তাসলিমা খুব অনুরোধ করল যেন আমি তার শশুরের পাশে একটু বসে তার অবস্থাটা বুঝি। আমি গেলাম। শুনলাম তিনি আমাদের প্রিয় চরমোনায় হুজুরের মুরিদ হয়েছেন। এই সিলসিলায় “ইল্লাল্লাহের” যিকির রাত দিন করতে হয়। আমি উনাকে বুঝায়ে বললাম যে এটা যিকির হতে পারেনা। এর চেয়ে আল্লাহর শেখানো ও রাসূলের (সা) শেখানো পন্থায় যিকির করলে ভালো। হয় শুধু “আল্লাহ” বলে যিকির করুন, না হয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলে যিকির করুন। মাঝখানে শুধু “ইল্লাল্লাহ” বলে যিকির করা মূর্খতা, কারো শেখানোর কারণে দীন মনে করে এই যিকির করলে এটা বিদআহ, এবং জেনে বুঝে এই বাক্যের অংশ না বলে শুধু শেষের অংশ বলা সুস্পষ্ট শিরক।
আমার তালই সাহেব আমাকে দারুন ভালোবাসতেন। তিনি মেনে নিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, আমি যখন ঐখানে বার্ষিক মাহফিলে যাই, দেখি মানুষেরা এই যিকির করতে করতে বাঁশের আগায় ওঠে। আমি বললাম, জামাই আমিও দেখেছি ঢাকার ধোপখোলা মাঠে এই যিকিরকারিরা বাঁশ বাইছেন। আসলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”কে যদি একটা পুরো বাঁশ ধরি, তালে ইল্লাল্লাহ হয় বাঁশের আগা। যেহেতু অর্থহীন, ভিত্তিহীন ও ইলিমহীন ভাবে মুরিদ সাহেব “ইল্লাল্লাহ” “ইল্লাল্লাহ” করে, তাই সে বাঁশের গোড়ায় না থেকে চলে যায় একদম আগায়। পাগল না হলে কেও এই ভাবে বাঁশের আগায় যায়? আর গোঁড়া না হলে কেও এই ভুলটাকে ভুল মানতে অস্বীকার করে? আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিন।